|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ৩... |
|
সামান্য থেকে অসামান্য |
এক দিকে তাঁরা জগন্নাথদেবের সেবক, তাঁদের তৈরি করা মৃৎপাত্র ছাড়া জগন্নাথের ভোগ ‘মহাপ্রসাদ’ হয়ে ভক্তের হাতে পৌঁছয় না, অন্য দিকে জগন্নাথ মন্দিরের ভিতরের অঙ্গনে তাঁদের প্রবেশাধিকার নেই। পুরীর জগন্নাথ মন্দির যতই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষণায় ভারতের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে, দেশের নানা প্রান্ত থেকে তীর্থযাত্রীদের আগমন বেড়েছে, মন্দিরের রান্নাঘর তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অনেক বেশি ভক্তকে মহাপ্রসাদ বিতরণের প্রয়োজন বেড়েছে। মৃৎপাত্রের প্রাত্যহিক চাহিদা মেটাতে মন্দিরের জন্য নির্দিষ্ট কুম্ভকারদের নিযুক্ত করা হয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু মন্দিরের কাছেই জমি দিয়ে তাঁদের বসতি করানোর দরকার হয় প্রয়োজন বাড়তে। পুরীর কুম্ভকারদের স্মৃতিতে আছে তাঁদের আদিমাতা নেলি বা নীলি কুম্ভারুনি-র কাহিনি— দূরের গ্রাম থেকে জগন্নাথের সেবার জন্য প্রয়োজনীয় মৃৎপাত্র জোগান দিতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতেন নীলি, কিন্তু জগন্নাথ দর্শনের সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। এক বার জগন্নাথ স্বয়ং পূর্ণগর্ভা নীলিকে দেখে তাঁর কথা জানতে চান। পরে জগন্নাথ রাজাকে স্বপ্নাদেশ দেন, নীলি যাতে মন্দিরের কাছেই থাকতে পারেন এবং রথযাত্রার সময় জগন্নাথকে দেখতে পান তার ব্যবস্থা করতে। এ ভাবেই গড়ে ওঠে আজকের কুম্ভকার বসতি, কুম্ভারপাড়া। জগন্নাথের সেবক, পুরীর কুম্ভকাররা এই নীলির সন্ততি। আজ রাজার রাজত্বও নেই, রাজার দেওয়া জমি জায়গা অধিকাংশই বেহাত। নগদ মূল্যে মৃৎপাত্রের জোগান দিয়েও নুন আনতে পান্তা ফুরোয় কুম্ভকারদের। তবু, জগন্নাথের সেবার অধিকার তাঁদের কাছে আজ-ও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে এমন নজির আর নেই।
১৯৭৯-’৮১-তে ওড়িশা রিসার্চ প্রজেক্ট-এ লুইস অ্যালিসন কর্ট এবং পূর্ণচন্দ্র মিশ্র পুরীর কুম্ভকারদের বিস্তারিত তথ্যায়ন করেন। টিকরপাড়া, কুম্ভারপাড়া ও গোপালপুরের কুম্ভকার বসতির এই অনুপুঙ্খ সমীক্ষায় উঠে এসেছে জগন্নাথ মন্দিরের জটিল সংগঠন, মন্দিরে বিশেষ মৃৎপাত্রের ব্যবহার, গ্রামীণ অবস্থানে কুম্ভকার সম্প্রদায়, ‘কুরাল পুরাণ’-এ বিধৃত তাঁদের সৃষ্টি-কাহিনি আর ‘কুরাল পঞ্চমী’তে তার উদযাপন, জাতপাতের বিচার, মন্দিরের জন্য তৈরি মৃৎপাত্রের বৈচিত্র ও বৈশিষ্ট্য (মসৃণ বহিরঙ্গের বদলে পিটিয়ে পিটিয়ে ছাপ দেওয়া, উজ্জ্বল লাল রঙ, ইত্যাদি), নির্মাণ-পদ্ধতি, সেবক-সত্ত্বার সঙ্গে দিনমজুরির নৈমিত্তিকতার দ্বন্দ্ব, এই সব কিছু। সেই সমীক্ষা এত দিনে বইয়ের আকার পেল টেম্পল পটার্স অব পুরী-তে (মাপিন, ৩৫০০.০০)। সামান্য মৃৎপাত্রের অসামান্য হয়ে ওঠার এ এক আশ্চর্য বৃত্তান্ত। |
|
|
|
|
|