|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ৩... |
মা হয়েছেন বলে ডিপ্রেশন |
আগে হত বন্ধ্যাত্বের কারণে। মা হতে না পারলে। আধুনিক সময়ে হচ্ছে মা হয়েও। লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
যদি বলি, প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ নিয়ে যত সব আবেগজড়িত, গদগদ কথা তার অনেকটাই রূপকথা মার্কা গল্প, তা হলে আদর্শ সমাজ ও পরিবারের ধারণায় বিশ্বাসীরা নিশ্চয়ই ক্ষিপ্ত হবেন। রে রে করে তেড়ে আসবেন সামাজিক নিয়মনীতির স্বঘোষিত প্রবর্তকেরা। মা হওয়ার মতো এত অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে এ কী কুত্সা! এত বড় আস্পর্ধা!
কিন্তু উটপাখির মতো বালিতে মুখ ঢুকিয়ে থেকে সত্যি কতটা লাভ? মা হওয়ার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে সুখের, তবে মাতৃত্বের পুরো রাস্তাটাই মাখনের উপর ছুরি চালানোর মতো মসৃণ নয়। সেই মুহূর্তটায় অদ্ভুত একটা টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েন বহু মেয়ে।
ন’মাস সন্তান বহনের কষ্টের পর সন্তান জন্মের ধকল, পাশাপাশি তাঁর শরীর বেঢপ হয়েছে, রাতে বাচ্চা ঘুমোচ্ছে না, ক্ষণে ক্ষণে চিল চিত্কার করছে, বারবার বুকের দুধ খাইয়েও খিদে মিটছে না, হিসু-পটি-ন্যাপি-কাঁথা-স্তন্যপান করানোর মধ্যে জীবনটা যেন আটকে গিয়েছে। আশপাশের সকলে মনে করছেন বাচ্চার দায়িত্বের পুরোটাই প্রায় মায়ের, একটু সাহায্য করবে এমন লোক পাচ্ছেন না। দিশেহারা লাগছে তাঁর, দমবন্ধ হয়ে আসছে।
এত দিন সমাজ-পারিপার্শ্ব তাঁদের পইপই করে বুঝিয়েছে, মাতৃত্বের মতো এত অপার্থিব সুখানুভূতি আর নেই। একসঙ্গে ময়ূর সিংহাসন আর কোহিনুর হিরে জিতে যাওয়ার মতো সাংঘাতিক ব্যাপার। অথচ, বাস্তবে জন্ম দেওয়ার পরেই বাচ্চার প্রতি অথৈ ভালবাসা বা উছলে পড়া মমত্ববোধ কিছুতেই আসছে না তাঁর। বরং কখনও-কখনও সাক্ষাত্ খুদে শয়তান বলে মনে হচ্ছে! তার জন্য কোথায় একটা অপরাধবোধও তাঁকে কুরে-কুরে খাচ্ছে। মনে হচ্ছে তা হলে কি আমার মানসিক সমস্যা আছে? মা হওয়ার যোগ্য নই আমি?
যত দিন যাচ্ছে মনের মধ্যে দমচাপা হয়ে আসছে ভয়। কী ভাবে এই বাচ্চাকে টেনে বড় করে তুলবে, অফিস যাওয়া শুরু হলে কী ভাবে বাচ্চা সামলানো যাবে, আয়া না এলে কী হবে, পুরনো ফিগার, চেহারার সৌন্দর্য কী করে কত দিনে ফিরে আসবে কিন্তু এই চিন্তার কোনওটাই খোলাখুলি আলোচনা করার লোক খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। বলা উচিত কিনা সেটাও বুঝে উঠতে পারছেন না। আশপাশের কেউ তাঁর মনের সেই ক্রমাগত ক্ষয় বুঝতেও চাইছে না। মেয়েটি তলিয়ে যাচ্ছেন অবসাদে, ভয়ে। তার পর এক সময় নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। সূত্রপাত হচ্ছে অস্বাভাবিক এক মানসিক অবস্থার যার নাম ‘পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন।’
বিয়ের বছর তিনেকের মাথায় মা হয়েছিলেন কসবার বাসিন্দা বছর তিরিশের এক মহিলা। শিশুর জন্ম দেওয়ার পরে রাতারাতি মহিলা বদলে গেলেন। মুখেচোখে আতঙ্ক। বাচ্চাকে ছুঁতে চাইছেন না। খাওয়াচ্ছেন না, নিজে খাচ্ছেন না। শুধু বলে চলেছেন, “কেউ আমার মনটাকে কন্ট্রোল করছে। আমি আমার বাচ্চাকে খাওয়াতে পারছি না। ডাক্তার-নার্সরা সব ষড়যন্ত্র করছে। ওরা আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে।” আবার কখনও বলছেন, “এই বাচ্চা আমার নয়, সরিয়ে নাও।” চিকিত্সকদের ব্যাখ্যায়, এটা হল পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের হাই-স্টেজ। একে ‘পোস্টপার্টাম সাইকোসিস’ও বলা হয়। সাধারণত সদ্য মা হওয়া মেয়েদের ১০ শতাংশের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে সংখ্যাটা অনেক বেশি হয়। |
|
কেন হয় এইরকম একটা পরিস্থিতি? পুরোটাই মানসিক ব্যাপার, নাকি শারীরিক কারণও এর সঙ্গে জড়িত?
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ গৌতম খাস্তগীরের মতে, শারীরিক-মানসিক দু’টো দিকই এর পিছনে কাজ করতে পারে। মাতৃত্বের ফলে দেহে কিছু নিউরো-ট্রান্সমিটার বা হরমোনের প্রবাহ গোলমাল হয়ে যায়। সেটা অবসাদ ডেকে আনতে পারে। আবার হঠাত্ উদ্ভূত কোনও পরিস্থিতি বা দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা চিন্তা-ভয় মায়ের মনে মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেস তৈরি করতে পারে। সন্তানের জন্মের পর সেটা এতটাই বাড়ে যে মানসিক স্থিতি নষ্ট হতে পারে।
এই রকম সব কেসের গল্প শোনাচ্ছিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়। বছর বত্রিশের এক মহিলার গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ মারাত্মক বেড়ে গেল। কিডনি আর লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হল। মা ও শিশুর জীবন বাঁচাতে শিশুর ডেলিভারি করে দেওয়া হল। শিশুকে রাখা হল ইনটেনসিভ কেয়ারে। আর মা চলে গেলেন ভেন্টিলেশনে। কয়েক দিন পরে ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে মা আর স্বীকারই করতে চান না যে, তাঁর কোনও বাচ্চা হয়েছে! আত্মীয়-স্বজন-চিকিত্সকদের গালাগাল দেন, চিত্কার করেন, বাচ্চাকে কাছে আনলে মেরে ফেলতে চান। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশ এমনও কেস পেয়েছেন যেখানে দমবন্ধ হয়ে সদ্যোজাতের মৃত্যু হয়েছে। এবং পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন থেকে মায়েরাই সদ্যোজাতের মুখে বালিশ বা চাদর চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছেন!
সময়মতো সমস্যা বুঝতে পারলে এবং চিকিত্সকের পরামর্শ নিলে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কাটানো সম্ভব তা একবাক্যে জানিয়েছেন চিকিত্সকেরা। পেরিন্যাটাল সাইকিয়াট্রিস্ট শ্রীমন্তী চৌধুরীর কথায়, অনেক মায়ের অতীত ডিপ্রেশনের ইতিহাস থাকে। এঁদের ক্ষেত্রে বাড়ির লোকের, বিশেষ করে স্বামীর আগাম সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ ডেলিভারির পর এঁদের পুরনো অবসাদ হঠাত্ চাগাড় দিতে পারে। তা ছাড়া, বাচ্চার কথা ভাবার আগে মেয়েটি বা ছেলেটি বাচ্চার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত কি না সেটা যাচাই করে নেওয়া অবশ্যই দরকার। এটা হয় না বলে অনেক সময় মা অবসাদের শিকার হন।
চিকিত্সকদের মতে, যাঁদের পরিবারে জোরালো ‘সাপোর্ট সিস্টেম’ নেই তাঁদের এইরকম সমস্যা বেশি হয়। সদ্যোজাতের দেখভালে হয়তো মা-কে কেউ সেভাবে সাহায্য করছেন না, বা মেয়েটি বুঝতেই পারেননি বাচ্চা হওয়ার পর জীবনটা এতটা কঠিন হয়ে যাবে। এখন তাঁর মনে হচ্ছে জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। অনেক চাকুরিরতার মনে আবার চেপে বসে ভাল অ্যাসাইনমেন্ট হারানো বা কেরিয়ারে পিছিয়ে পড়ার ভয়। এই রকম পরিস্থিতিতে সদ্য প্রসূতির অবসাদ লাগামছাড়া হতেই পারে।
মনোবিদ মোহিত রণদীপ আবার জানান, বাচ্চা জন্মানোর পর অনেকের মনে হয়, জীবনে স্বাধীনতা চলে গেল, চব্বিশ ঘণ্টার দায়িত্ব-চাপ এসে গেল। অনেকে ভাবেন, স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা বা যৌন সম্পর্ক ধাক্কা খাবে। পরস্পরের মনোযোগ আর তাঁরা পাবেন না। এ সব কারণে শুধু মায়েরা নন, অনেক সদ্য-বাবাও অবসাদে ভোগেন।
আফ্রিকার উগান্ডায় ‘অ্যামাকিরো’ নামে একটি রোগ কুখ্যাত। এটা ওই এলাকার অনেক সদ্য প্রসূতির দেখা যায়। এতে আক্রান্ত মায়েরা সদ্যোজাতকে মেরে খেয়ে ফেলেন! বিষয়টা নিয়ে অনেক গবেষণা অতীতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। চিকিত্সকেরা একমত যে, এটা পোস্টপার্টাম সাইকোসিসের চূড়ান্ত একটা রূপ।
ব্রুক শিল্ডের মতো হলিউড দিভাও সন্তানের জন্মের পরে মারাত্মক অবসাদের শিকার হয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পরে সেই সমস্যা নিয়ে বইও লিখেছেন শিল্ড। তাতে বলেছেন, ‘‘রোয়ানের (তাঁর মেয়ের নাম) জন্মের পরে ওঁকে ছুঁতেই ভয় করত। শুধু কান্না পেত। ম্যানহ্যাটন অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচ তলায় জানলা দিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। বার বার মনে হত, জানলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবনটা শেষ করে দিই। তবে হার মানবেন না। এই অবস্থা থেকে বার হওয়া সম্ভব।’’
একটু সতর্ক থাকা, একটু সাহায্যের হাত, সহানুভূতি, খোলামেলা আলোচনা, দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া। তাতেই যাবতীয় সাইকোসিস পিছনে ফেলে মাতৃত্বের রূপকথা তৈরি আর কঠিন হবে না।
|
অবসাদ এড়াতে |
• বাচ্চার পরিকল্পনা করার আগে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মন যাচাই করুন।
• সাপোর্ট সিস্টেম ঠিক রয়েছে কি না দেখুন।
• মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকুন যে, জীবনের রুটিন অনেকটা বদলাবে।
• মনকে এটাও ভাবান যে সন্তানের জন্ম দিয়েও মেয়েরা ঘরে-বাইরে সফল। তখন আপনিও পারবেন।
• মনে রাখবেন, বাচ্চা জন্মানোর প্রথম দু’মাস যতটা অসহনীয় লাগে, পরে অতটা নয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।
• সদ্যপ্রসূতির আচরণে সামান্য পরিবর্তন দেখলেই চিকিত্সকের পরামর্শ নিন। কাউন্সেলিং করান।
• তাতে ঠিক না হলে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ওষুধ শুরু করতে হবে।
• চিকিত্সা চলাকালীন শিশুকে মায়ের কাছে রাখবেন না। বুকের দুধ এই পরিস্থিতিতে না খাওয়ানোই উচিত।
• সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর এই অবস্থার কথা মা-কে মনে করাবেন না।
• মনে রাখবেন আবার কোনও সময় এই অবসাদ ফিরে আসতে পারে। তাই সতর্ক থাকুন। |
পরামর্শ: ডা. গৌতম খাস্তগীর, ডা. মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়, ডা. শ্রীমন্তী চৌধুরী
|
|
|
|
|
|
|