হাঁড়ির খবর
ফ্রেঞ্চ কাট
রাসি চুমু থেকে সুগন্ধির নাম-ডাক তো মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু এমন ফরাসি ধাঁধাটি আমাদের অনেকেরই মাথায় ঢোকে না।
কী খাব আর কী খাব না-র টানাপোড়েনে জীবনধারণের পদে পদে যখন গ্লানির পাহাড় জমছে, তখন এমন ফরাসিয়ানা যেন বিরল ভরসার সুরভি। দেশে-দেশে বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘ফ্রেঞ্চ প্যারাডক্স’। রেওয়াজি খাসির মাংস, খাঁটি ঘি বা ভাল সন্দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার আত্মপীড়ন ঢের হয়েছে। ফরাসিদের দেখো, শেখো! ভারত-ফ্রান্স দোস্তির স্মারক ‘বঁজু ইন্ডিয়া’(bonjour india)-উৎসবে সম্প্রতি কলকাতার এক খাঁটি ফরাসি নৈশাহারে পাত পেড়ে বসে ঠিক এটাই মনে হচ্ছিল। জীবনের সেরা আনন্দগুলো থেকে নিজেদের বঞ্চিত না-করেও যে বেঁচে থাকা সম্ভব, তা ফরাসিদের দেখে শেখা ছাড়া উপায় নেই।
ফরাসি খানার মহিমা-কীর্তনের আগে ধাঁধার বিষয়টি খোলসা করে নেওয়া যাক। ধাঁধা ফরাসিদের খাদ্যাভ্যাসে। কোর্স ধরে-ধরে গুচ্ছের চিজ, মাংস, গলানো ফ্যাট, লিভার, ওয়াইন এত কিছু নিয়মিত সাঁটিয়েও ফ্রেঞ্চ নরনারী কী করে এমন ছিপছিপে স্বাস্থ্যের মালিক, তা শুধু হিংসুটে বাঙালি নয়, দুনিয়াসুদ্ধ সবাই খানিকটা আড়চোখে দেখে। বছর দশেক আগেও রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেবে ফাঁস হয়েছিল, ফরাসিরা আমেরিকানদের তুলনায় ঢের বেশি অ্যানিমাল ফ্যাট হজম করেন।
মাখন, চিজ ও শূকরমাংস-প্রীতিতেও গড়পড়তা মার্কিনী ফরাসির ধারে-কাছে আসবে না। তবু হার্টের অসুখের প্রকোপে আমেরিকানরাই ঢের বেশি কাবু। আয়ুর দৌড়েও ফরাসিরা বরাবরই আমেরিকানদের থেকে এগিয়ে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০০৫-১০ সালের হিসেবে তো ফরাসি মহিলাদের আয়ু এ গ্রহে ঠিক জাপানিদের পরেই।
বস্তুত, ডাক্তার থেকে ডায়েটিশিয়ানরা অ্যাদ্দিন পই-পই করে যা-যা বারণ করে গেলেন, ফরাসি মেনু যেন তার বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ। রেডমিট খেও না। ফ্যাট এড়িয়ে চলো! বেশি মাংস, মিষ্টি, মদ্য থেকে সাবধান! এই সব ক’টা সাবধানবাণীকেই ফ্রেঞ্চরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন। কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ডিরেক্টর স্তেফানে আমালির আবার সুর চড়িয়ে ফরাসিদের ব্রেকফাস্ট কার্যত না-করা এবং লাঞ্চ-ডিনারের ফাঁকে দীর্ঘ ক্ষণ পেট খালি রাখার বদঅভ্যেসটুকুও অনিয়মের লিস্টিতে যোগ করছেন। ফরাসি ধাঁধাটি অতএব সত্যিই জটিল। সমাধান-সূত্র খুঁজতে গিয়ে সমালোচকেরা কেউ কেউ বিষয়টা স্ট্যাটিসটিক্সের ধাপ্পাবাজি বলে আক্রমণ করেছেন। কখনও বা উঠে এসেছে ফরাসিদের অলিভ অয়েল ও রেড ওয়াইন-বিলাসের তত্ত্ব। ফরাসিদের সতেজ হৃদযন্ত্রের গপ্পো প্রথম বার শুনে তো দু’দশক আগে হঠাৎই আমেরিকায় ওয়াইন-আসক্তির বহর এক লাফে বেড়ে গিয়েছিল।
ফ্রেঞ্চ প্যারাডক্সের তবু উত্তর মেলেনি। বঁজু ইন্ডিয়া-য় ফরাসি ভোজ-বিলাসের সাতকাহন এ দেশে পর পর জয়পুর, কলকাতা, তিরুঅনন্তপুরম, পুণে, পুদুচেরিতে পাড়ি দিয়েছে। অনেক দিন বাদে কলকাতায় বসে হায়াতে তাই বুদ্ধদেব বসু-কথিত ‘হংস যকৃৎ পিষ্টক’ ফোয়া গ্রা-র (foie gras) দেখা মিলল। সাদা বাংলায়, রাজহাঁসের পুরুষ্টু লিভার।
হাঁসকে জোর করে খাইয়ে কী ভাবে তার লিভারটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিরাট করে তোলা হয়, তার কসরতে অনেকেই ভয়ানক নিষ্ঠুরতার ছায়া দেখেন, সে-সব খুঁটিনাটিতে যাচ্ছি না! তবে মরার আগে, ফরাসিমাত্রেই বোধহয় একবার ফোয়া গ্রা খেতে চাইবেন। ফ্রান্সের পাড়াগাঁয়ে ঘুরতে বেরিয়ে প্রথম বার চেখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল, এমন সুস্বাদু বস্তু তিনি আগে খাননি। আমাদের ভাগ্য, এ জিনিস কলকাতায় বসেই এখন জুটে যেতে পারে। হায়াত রিজেন্সি হোটেলে সুগন্ধী মশলাদীপ্ত পাঁউরুটি ও ফিগের সঙ্গে ফোয়া গ্রা খেলে মাংস বলে মনেই হয় না। যেন উচ্চাঙ্গের এক দলা মাখন। এ তো রোজ খাওয়ার নয়। কোলেস্টেরল নিয়ে যাবতীয় পাপবোধ ঝেড়ে ফেলে মন খোলা রেখে এ জিনিস খান।
ফোয়া গ্রা-র পরে স্যুপ-কোর্সে কালো বিউলির ডাল (তড়কার ডাল) দিয়ে লেন্টিল স্যুপ। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত ভারতীয় ফিউশন। চিজের অভিঘাতে স্বাদু। লবস্টারের নিরাভরণ ঝোল বা বিস্ক, ভেটকির পোচ হয়ে চিজ-কোর্স পেরিয়ে চকোলেট মুসের ডেজার্ট। মাখন-স্নাত লেবু-সুরভিত ভেটকির পদটি বড় ভাল। আর অতি উঁচু জাতের চকোলেটে মোড়া কাঠবাদামের বিস্কুট খেতে খেতে বাকি দুনিয়াটা অবান্তর মনে হয়। একেবারে নিখুঁত মাপা মিষ্টি ও রমণীয় তিক্ততায় সুমহান দলা-দলা চকোলেট। সঙ্গে কোর্সপিছু রেড বা হোয়াইট ওয়াইন, শ্যাম্পেনের ব্যবস্থা।
ফ্রান্স থেকে শেফ স্তেফান মাতন এসেছিলেন রান্নার আয়োজনে। আর মূল সংগঠক নয়না দ্য বোয়া সুজান। নয়না আধা ফরাসি, আধা পঞ্জাবি। প্যারিস ও দিল্লিতে মিশিয়ে থাকেন। এই তরুণী শিগ্গিরই দিল্লিতে ফরাসি রেস্তোরাঁ খোলার তোড়জোড় করছেন। ফরাসি ধাঁধার রহস্যভেদে নয়নার সঙ্গেও কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ফ্রান্সে চিজ-মাংসটাংস চুটিয়ে খাওয়া হলেও আদতে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে কিন্তু যথেষ্ট ভারসাম্য। এক-একটি আমিষ কোর্সের সঙ্গেও বিস্তর সব্জি-টব্জি, কখনও বা একটু ভাতেরও ব্যবস্থা থাকে। সেরা উপকরণ, স্বাদের সূক্ষ্মতা ও পরিবেশনের আভিজাত্যের সঙ্গে এই ভারসাম্যটুকুও জরুরি।
ফোয়া গ্রার মতো উপাদেয় বস্তু ফ্রান্সেও কেউ রোজ খান না। তবু দুপুরে বা রাতে যথেষ্ট মাংস, চিজ খাওয়ার রেওয়াজ প্রবল। ডায়েটিশিয়ান রেশমি চট্টোপাধ্যায় এই ফরাসি ধাঁধাকে সে-দেশের ভূগোলের নিরিখেই ব্যাখ্যা করছেন। “ফ্রান্সের আবহাওয়ায় যেটা পোষায়, সেটা কলকাতায় চলবে ভাবা ঠিক নয়। কলকাতার গ্রীষ্মে এত ভারী ভারী খাবার খেয়ে ক্যালরি-ক্ষয় অত্যন্ত ঝামেলার।” তবু শরীরে ফ্যাটের প্রয়োজনের বিষয়টা কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেন না রেশমি। পুষ্টিবিশারদদের মতে, সুস্থ শরীরে একটু-একটু করে সব ধরনের খাবার খাওয়াই কিন্তু জরুরি। সে দিক দিয়ে অকারণে বাড়তি সাবধানতায় রেডমিট বা খাঁটি ঘিয়ে ভাজা লুচি জীবন থেকে একেবারে মুছে দেওয়ার মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই।
ডায়েটিশিয়ন কালি পুরী আবার তাঁর ‘গোল্ডেন ক্যালরি’র তত্ত্বের সওয়াল করবেন। গোল্ডেন ক্যালরি মানে বিশেষ উপলক্ষের সেরা সুখাদ্য। এই স্বাদ-আহরণের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। সপ্তাহের অমুক দিনে কব্জি ডুবিয়ে মাংস বা চিংড়ি খাবেন বলে অন্য দিনগুলোয় মেপে স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে নিজেকে তৈরি করুন। ভাল জিনিসটার সামনে পড়লে তার পরে আর ক্যালরির পরোয়া করতে হবে না। ও হ্যাঁ, ফরাসিদের আর একটি মহৎ গুণ, পরিমিত ভোজন। ফ্রান্সে দোকান খুলে ম্যাকডোনাল্ডস অবধি বার্গারের আয়তন ছোট করেছে।
শুক্তো থেকে মাছ-মাংস হয়ে দইয়ের পদে বাঙালি ভোজনরীতিতেও অনেকেই ফরাসি কোর্সের ছায়া দেখেন। বাস্তবিক, ফরাসিদের মতো কম-কম খেলে বাঙালিও মনে হয় যাবতীয় নিষিদ্ধ বস্তু উপভোগ করেই বেঁচেবর্তে থাকতে পারবে। যা বলছিলাম, খাসির সুমহান ঝোল বা সন্দেশের স্বাদ ভুলে যাওয়াটা আর যা-ই হোক মানবসভ্যতার জন্য মঙ্গলময় হবে না।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.