ব্যাগ গুছিয়ে...
করাল কুম্ভীর সন্ধানে
ম্যানগ্রোভ কী, পরিবেশ সংরক্ষণে তার উপকারিতা কী, কোনটা শ্বাসমূল, কোনটা ঠেসমূল এ সব শুনতে শুনতে মেজাজটা ক্রমেই তিরিক্ষে হয়ে উঠছিল।
বিশ্বের সব থেকে বড় ব-দ্বীপ আর সব থেকে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য রয়েছে আমাদের রাজ্যে। ছোটবেলা থেকে সুন্দরী, গরান, গেঁয়ো গাছের সঙ্গে সখ্য। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে চোখাচোখি এক বারও হয়নি, কিন্তু সুন্দরবনের রাজার ঘরদোর দেখা হয়েছে অন্তত কুড়ি বার। তাই ম্যানগ্রোভ নিয়ে ট্যুর গাইড ড্রিউ হ্যামিলটনের জ্ঞান কানেই ঢুকছিল না। অন্যেরা মন দিয়ে শুনছিল। আমার নজর ছিল জলের দিকে। ভাটার টানে জল নেমে এসেছে। শ্বাসমূলের আনাচেকানাচে চোখ ঘোরাফেরা করছে, যদি দেখা মেলে ওদের।
আমরা কুমির দেখার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি কুইন্সল্যান্ডের একেবারে উত্তরে মসম্যান শহর-সংলগ্ন ডেইনট্রি নদীতে। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড প্রদেশ কুমিরের জন্য বিখ্যাত। এর আগে কেইর্নসের খাঁড়িতে ক্রুজে চেপে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে কুমির খুঁজে বেড়িয়েছি একটা গোটা বিকেল। লাভ হয়নি তাতে। কুমির কেন, একটা বকও দেখতে পাইনি প্রায় দু’ঘণ্টার জলযাত্রায়। বৃষ্টিতে ভিজে একশা। তাই আমাদের গাইড রোজালিন যখন কেইর্নস থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার উত্তরে মসম্যানে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন তখন তেমন উৎসাহ বোধ করিনি। রোজালিন লোভ দেখালেন, “ডেইনট্রির জলে বাস করে বিশাল আকারের কুমির। এক বার ভাগ্যপরীক্ষা করে দেখতে ক্ষতি কী!”
ডেইনট্রি নদীটা আমাদের সুন্দরবনের হোগল কিংবা গোসাবা নদীর মতো। প্রস্থে তা খুব একটা বেশি নয়। আমরা যে জলযানে চেপে বসলাম সেটাও ভুটভুটিরই উন্নত সংস্করণ। ইঞ্জিনটা ভাল। বেশি শব্দ করে না। গল গল করে কালো ধোঁয়াও বেরোয় না। পোড়া ডিজেলের গন্ধ নেই। নৌকা তৈরি ফাইবার গ্লাসে।
তবে জলে তার গতি কিন্তু আমাদের ভুটভুটিরই সমতুল। হ্যামিলটন আমাদের সঙ্গে নৌকায় তুলে নিলেন তাঁর আদরের কুকুর জিনাকেও। নৌকায় উঠেই রোদে পিঠ দিয়ে সে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। নৌকার দুলুনিতে তার চোখ বুজে এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। নৌকা কুমিরের খোঁজে নদীর দুই ধার চষে বেড়াচ্ছে।
আধ ঘণ্টা পরে দেখা তার সঙ্গে। দূর থেকে দেখলাম ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ধার ঘেঁষে জলের মধ্যে নড়ছে একটা কাঁটাযুক্ত লেজ। তার পরে জলের উপরে দেখা গেল পুরো শরীরটাকে। হ্যামিলটন রীতিমতো উত্তেজিত, “এটাই আমাদের এখানকার ‘ওয়াটার মনস্টার’ জলের দৈত্য। ওটা একটা পুরুষ কুমির। দৈর্ঘ্যে কম করে চার মিটার তো হবেই। ওকে অনেক দিন দেখিনি। পর্যটকদের কাছে ওর কথা আমরা বলি। কিন্তু ওর দেখা পাওয়া কঠিন। আপনারা ভাগ্যবান।”
বিশাল ওই দৈত্যের একেবারে কাছে নৌকা নিয়ে গেলেন হ্যামিলটন। তিনি যেন মজা পেয়ে গিয়েছেন। আমাদের বুক তখন ধকধক করতে শুরু করেছে। যদি কোনও ভাবে নৌকা উল্টে যায় তাহলে বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে যেতে হবে কুমিরের পেটে। ভাবছিলাম আমাদের সুন্দরবনের কুমিরের মতো নৌকার আওয়াজ, ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে বোধ হয় ওই জলের দানবটা ভুস করে ডুব মারবে। কিন্তু কোথায় কী, হ্যামিলটন ওর একেবারে সামনে নিয়ে গেলেন নৌকা। তবু তার কোনও হেলদোল নেই। নদীর ধার ধরে সাঁতার কেটেই চলেছে। হ্যামিলটন বলেন, “ও নিশ্চয় সঙ্গিনীর খোঁজে বেরিয়েছে। ওর অন্য দিকে কোনও নজরই নেই। তবে আর একটা পুরুষ কুমির আসুক, দেখবেন মজা। তবে ওর যা বিশাল আকৃতি অন্য কেউ কাছেই ঘেঁষবে না।”
দৈত্যটার পাশাপাশি আমরা অন্তত এক কিলোমিটার এগিয়ে গেলাম। নিজের মনে ও সাঁতার কেটে চলেছে। আমাদের উপস্থিতিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। মনের চোখে ছবি তুললাম। আফশোস হচ্ছিল একটা দামি ক্যামেরা সঙ্গে না থাকার জন্য। হ্যামিলটন এক সময়ে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিলেন, “ওকে ওর মতো থাকতে দিন। এটা ওর সাম্রাজ্য। আমরা অন্য কিছু পাই কী না দেখি।”
মূল নদী ছেড়ে হ্যামিলটনের নৌকা এ বার ঢুকে পড়ল খাঁড়িতে। একটু এগিয়ে আবার তিনি পিছিয়ে নিয়ে এলেন নৌকা। নিয়ে গেলেন একেবারে পাড়ের কাছে। একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা শ্বাসমূলের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, “দেখুন কেমন রোদ পোহাচ্ছে।” গায়ের রঙ হলদেটে ধূসর। আকার একটা বড় গিরিগিটির মতো। কুমিরছানা। হ্যামিলটন বললেন, “ওটার বয়স বছরখানেক হবে। এখন ভাটা শুরু হয়েছে। মাটি থেকে পোকামাকড় বেরোয়। তার জন্যই অপেক্ষা করছে ওটা।” ফেরার পথে ম্যানগ্রোভের ভাঙা ডালে আরও একটা কুমিরছানার সঙ্গে দেখা হল। সেটা বয়সে আরও ছোট। কুমির নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা হ্যামিলটন বললেন, “প্রতি বার এ রকম কয়েকশো কুমিরছানা ডিম ফুটে বেরোয়। তাদের শতকরা ৮০ ভাগই কিন্তু বছর তিন পার করার আগেই চলে যায় অন্য কারও পেটে। এটার শেষ পর্যন্ত কী দশা হবে কে জানে!”
মসম্যানের অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল পর্যটন এবং আখের উপরে। রাস্তার দুই ধারে চোখ জোড়ানো আখের খেত। মাঝেমধ্যে বিশাল বিশাল খামার বাড়ি। মসম্যান এবং ডেইনট্রি নদী এঁকেবেঁকে গিয়েছে তার মধ্য দিয়েই। কুইন্সল্যান্ডে আমাদের গাইড রোজালিন বললেন, “মসম্যানে যখন এসেই পড়েছি তখন সমম্যান জর্জ না দেখলেই নয়। অস্ট্রেলিয়ার আদি বাসিন্দা আ্যাবোরিজিন্যালসদের এলাকা ওটা। কী ভাবে ওরা জঙ্গলকে নিজেদের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন সে ব্যাপারে ধারণা হবে ওখানে গেলে।”
বিশাল বিশাল গাছের ওই জঙ্গলে আকাশ দেখা যায় না। এখানে সেখানে কাঁটা-বেতের ঝোপ। পাহাড় থেকে নেমেছে ঝরনা। তার মধ্য দিয়েই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ফিলিপ। আমাদের অ্যাবোরেজিন্যাল গাইড। জঙ্গলে ঢোকার মুখে একপ্রস্ত পুজোআচ্চা হল। গাছের ছাল পাকিয়ে তাতে আগুন জ্বালালেন ফিলিপ। ধূপের গন্ধ-মাখা একরাশ সাদা ধোঁয়া বেরোলো। বিড় বিড় করে কী একটা মন্ত্র পড়তে পড়তে আমাদের প্রত্যেককে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করলেন এক মাথা কোঁকড়ানো চুলের শক্ত সামর্থ যুবকটি, “আপনারা বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমরা কিন্তু অপদেবতা মানি। আমরা মনে করি জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় অপদেবতা, অতৃপ্ত আত্মা। ওদের সাহায্য না পেলে আমরা জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলতে পারি।”
পাহাড়ের গায়ে পায়ে চলা রাস্তা। একটা গাছের সামনে এসে কিছুটা দাঁড়ালেন ফিলিপ। তুলে নিলেন গাছের নীচে পড়ে থাকা এক ধরনের ফল। আমাদের বটের ফলে মতো। তার পরে সেই ফলের গায়ে লাইটার থেকে আগুনের শিখা ধরলেন। দপ করে জ্বলে উঠল সেটি। ফিলিপ বলেন, “জঙ্গলের মধ্যে এই ফলগুলি মোমবাতির কাজ করে। রাতে যাতে কেউ পথ না হারিয়ে ফেলে সে জন্য জায়গায় জায়গায় এই ফলটা জ্বালিয়ে রাখি আমরা। এক একটা ফল অন্তত আধ ঘণ্টা পর্যন্ত জ্বলে।” জঙ্গলের মধ্যে আত্মরক্ষার জন্য কী ভাবে বেতের কাঁটার সঙ্গে গাছের বিষাক্ত আঠা তাঁরা লাগান সেটাও দেখালেন ফিলিপ। রেইন ফরেস্টের শতায়ু বিশাল গাছের কোন কাণ্ড দিয়ে বুমেরাং তৈরি হয়, কোনটা দিয়ে বল্লম, কোনটা দিয়ে লাঠি তৈরি হয় তা দেখালেন। বিশাল গাছের মূলগুলি ছড়িয়ে পড়েছে এক কিলোমিটার পর্যন্ত। কোথাও গাছের মোটা মোটা মূল নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি করে তৈরি করেছে একটা গুহা। ফিলিপ বলেন, “আমরা ওই গাছের আশ্রয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারি রাত।”
তবে ফিলিপদের এখন আর জঙ্গলের উপরে তেমন নির্ভর করতে হয় না। পড়াশোনা করে ওঁরা এখন চাকরি করেন। তাই জঙ্গলটা এখন স্রেফ পযর্টক-আকর্ষণ।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.