কাট ওয়ান: সন্ধে ছ’টা। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে ইডেন কিউরেটর প্রবীর মুখোপাধ্যায়। মেঘ জমেছে, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি নামল বলে। লক্ষ্মীরতন শুক্লকে নিয়ে আচমকাই তাঁর দিকে হাঁটতে শুরু করে দিলেন গৌতম গম্ভীর। পিচের দিকে মাঝে মাঝে তর্জনী তুলে মিনিট পাঁচেকের বৈঠক। মুহূর্তে ফটোগ্রাফারদের শাটার পড়ার দুদ্দাড় শব্দ।
দুইয়ে আবার লাগল বোধহয়!
নাহ্। লাগেনি। নাইট ক্যাপ্টেন আসলে টার্নার খুঁজছেন! ইডেন কিউরেটরের কাছে বিনীত আবেদনআমাদের ‘পাওয়ার হাউস’-এর ব্যাপারটা একটু মাথায় রাখবেন। মানে, স্পিন। সুনীল নারিন। উইকেটটা যতটা পারা যায় শুকিয়ে ফেলুন।
এত পর্যন্ত পড়লে নাইট সমর্থকদের কপালে বলিরেখার সন্ধান পাওয়াই স্বাভাবিক। শনিবাসরীয় মহাযুদ্ধে নাইটদের প্রতিপক্ষ যারা, তাদের যে স্পিন-খেলিয়ে বলে শুধু নয়, মোক্ষম স্পিনার লেলিয়ে দেওয়াতেও যথেষ্ট নামডাক আছে! অধুনা ভারতীয় ক্রিকেটের এক নম্বর স্পিনারই তো সিএসকে-র জার্সি পরেন। রবিচন্দ্রন অশ্বিন। তাদের বিরুদ্ধে কি না টার্নারের আবদার? কোন যুক্তিতে?
শুনে এক নাইট রাতে বলে দিলেন, “চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে কোন পিচটা সেফ বলতে পারেন? যা খুশি পিচ দিন, সেই মতো টিম ওরা নামিয়ে দেবে। তার চেয়ে নিজেদের শক্তি মতো পিচ চাওয়া ভাল নয় কি?”
অকাট্য যুক্তি। পাল্টা প্রশ্ন চলে না। |
কাট টু: ব্রেট লি। জাক কালিস। ব্রেন্ডন ম্যাকালাম। ট্রেভর বেলিস। পুরো নাইট সংসার একটা নিখুঁত বৃত্তে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ‘টিম হাডল’-এর কোহিনুর যিনি, সেই গম্ভীরকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। একটু পর দেখা গেল, ড্রেসিংরুম থেকে বেরোচ্ছেন। হাতে দু’টো ব্যাট। ক্লাবহাউসের লোয়ার টিয়ার থেকে একটা চাপা চিৎকারও উঠল, কিন্তু কেকেআর ক্যাপ্টেন ভ্রূক্ষেপ করলেন না। গটগটিয়ে ‘টিম হাডলে’ ঢুকলেন এবং ঢুকেই যে বার্তাটা দিলেন, তা এ রকম: ঘরের মাঠে পরপর তিনটে ম্যাচ পাচ্ছি। আইপিএলে ভাসব না ডুবব, অনেকটাই ঠিক করে দেবে এই তিনটে ম্যাচ। আর শনিবারের ম্যাচটা মরণ-বাঁচন। নিজেদের সর্বস্ব দাও, মনে রেখো এটা জীবনের যুদ্ধ।
দুপুর থেকেই শেষ দুটো শব্দ শোনা যাচ্ছিল না? কতই না ‘ক্যাচলাইন’ মিনিটে-মিনিটে জন্ম নিচ্ছিল জাতীয় মিডিয়ায়।
জীবনের যুদ্ধ।
প্রতিশোধের ম্যাচ।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের শৈত্যকে স্ফুলিঙ্গে বদলে দেওয়ার পোডিয়াম।
কোথাও ‘জীবনের যুদ্ধ’ শিরোনাম সমেত দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে গম্ভীরকে। কোথাও আবার একক নায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এবং আইপিএল ফাইভ ফাইনালের হারের অপমান। কোথাও আবার মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধোনি-গম্ভীর সম্পর্ককে। দু’জনের সম্পর্ক ঠিক কতটা ‘মধুর’ ভারতীয় ক্রিকেটমহলে কারও অজানা নয়। নাইট অধিনায়ক আর টেস্ট টিমে নেই। বাদ পড়েছেন। বারুদ এখন জ্বলবে না তো আর কবে জ্বলবে?
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, রোম্যান্সের গজ-ফিতেয় মহাযুদ্ধকে মাপতে গেলে শুধু ভুল নয়, ঐতিহাসিক ভুল হবে। বরং ইডেনে হার-জিতের রেকর্ডে, সাম্প্রতিক পারফম্যান্স শিটে এমএসডি-র ‘মেন ইন ইয়েলো’ কয়েক মাইল এগিয়ে। আজ পর্যন্ত পাঁচ বার ধোনির বিরুদ্ধে ইডেনে নেমেছে কেকেআর। কখনও সৌরভ। কখনও গম্ভীর। সম্মিলিত হারের হিসেব পাঁচে চার। ধোনি শহরে ঢুকলেন সহবাগের দিল্লিকে চুরমার করে। আর পঞ্চনদের দেশে গম্ভীরের প্রাপ্তি লজ্জার হার। দুই টিমের মননের বৈপরীত্যও ধরা পড়ছে অদ্ভুত ভাবে। |
এমএসডি-র চোখে ঘুম নেই। ভোর তিনটেয় টুইট করছেন, আদতে যা মস্করা। ‘সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত কোনও বিমান দিল্লি নামেনি। স্যর রবীন্দ্র জাডেজা কাছাকাছি একটা ফার্মহাউসে ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন যে!’ ‘ভাবছি, যদি কখনও স্যর জাডেজার বোলিংয়ের সামনে রঞ্জি স্যর পড়তেন, তাকে বলা হত ক্ল্যাশ অব দ্য টাইটানস!’
বেলিসেরও ঘুম নেই। টেনশনে, টিমের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায়।
টিম কম্বিনেশন চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। বিদেশির স্লটে পরিবর্তন আসছে নিশ্চিত, কিন্তু কার বদলে কে, অনিশ্চিত। শনিবার ম্যাকালামের খেলার সম্ভাবনা পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। তিনি ঢুকলে সেনানায়কে হয়তো ডাগআউটে, বিসলাকেও দরকার পড়ার কথা নয়। লক্ষ্মীরতন শুক্ল ফিট। বল করতেও অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু যুদ্ধের প্রস্তুতিতে কে কোন অবস্থায়, সেটাই তো দেখে নেওয়া গেল না। সন্ধেয় বৃষ্টি এল (আজও আশঙ্কা আছে), প্র্যাকটিসও অর্ধসমাপ্ত রেখে ফিরতে হল হোটেলে।
তা হলে প্রাপ্তি? অস্ফুট কিছু বিলাপ। বিকেলে ইডেনের মিডিয়া রুমে যেগুলো ট্রেভর বেলিসের গলা থেকে ভেসে আসছিল, “টিমটার যা ক্ষমতা, সেই মতো খেলতে পারছে না,”....“ইউসুফকে রানে ফেরানোর সব রকম চেষ্টা করছি”...“টিমটা মার খেয়ে যাচ্ছে কনফিডেন্সে, এক বার কনফিডেন্সটা ফিরলেই...।”
আইপিএল শুধুই বিনোদনের, কথাটা নেহাত অর্ধসত্য। |