নামেই মহকুমা হাসপাতাল। পূর্ব মেদিনীপুরের শিল্পশহর হলদিয়ার সরকারি হাসপাতালটিতে স্বাস্থ্য পরিষেবা তলানিতে এসে ঠেকেছে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অভাব প্রকট। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হাসপাতালের মর্গের। এক জনও সার্জেন নেই। অথচ মহকুমার যত অস্বাভাবিক মৃত্যুর ময়না-তদন্ত হচ্ছে নির্বিচারে। অবস্থা এমনই প্রয়োজনে শিশু বিশেষজ্ঞকেও ময়না-তদন্ত করতে হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেল, জরুরি-সহ বিভিন্ন বিভাগ মিলিয়ে যেখানে ৪৫ জন চিকিৎসক থাকার কথা, সেখানে রয়েছেন মাত্র ২৪ জন। সার্জেন দু’জন থাকলেও অটোপ্সি বিভাগে কেউ নেই। ফলে পালা করে অন্য বিভাগের চিকিৎসকেরা
ময়না-তদন্ত করেন। ৮১ জন নার্সের মধ্যে রয়েছেন ৪২ জন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর ৬৪টি পদে রয়েছেন ২২ জন। মহিলা কর্মী মাত্র ৮ জন, যেখানে স্ত্রীরোগ বিভাগে ৩ জন, মহিলা সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে ৩ জন ও বহির্বিভাগে ৫ জন মিলিয়ে মোট ১১ জন প্রয়োজন। ওয়ার্ড মাস্টার ও স্টোর কিপারের তিনটি করে পদ থাকলেও কেউ নেই। ৪৫ জন সাফাইকর্মীর জায়গায় রয়েছেন ১২ জন। এর উপরে দায়িত্ব পালনে অনিয়ম তো আছেই। হাসপাতাল সূত্রে খবর, বেশ কিছু নার্স ও চিকিৎসক পরপর তিনটি শিফটে কাজ সামলে তিন দিনের ডিউটি দেখিয়ে দিচ্ছেন। নার্স ও চিকিৎসকদের বক্তব্য, নিজের বিভাগ সামলে জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগ সামলাতে হচ্ছে। এত কাজের চাপ সামলাতে গিয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন তাঁরা। এক চিকিৎসকের কথায়, “সত্যি বলতে কি এ ভাবে কাজের মানসিকতা থাকে না। তা-ও যতটুকু সম্ভব মন দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি আমরা। তবে ছুটি তো সকলেরই প্রয়োজন। তাই দূরে বাড়ি হলে অনেকে একটানা কাজ করে বাড়ি ঘুরে আসেন।” |
এ দিকে, চিকিৎসকের অভাবে বাড়ছে ‘রেফার’ সমস্যা। চৈতন্যপুরের দেউলপোতা থেকে আসা এক রোগীর পড়শি চন্দনকুমার রানা বলেন, “অনেক সময়েই চিকিৎসকের অভাবে ফিরে যেতে হয়। যে বিভাগের চিকিৎসকের, কাছে এসেছি, তাকে পাই না। রোগীকে রেফার করে হাঁফ ছাড়েন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।” হাসপাতালের সুপার হারাধন বর্মণ চিকিৎসকের অভাবের কথা মেনে নিয়ে বলেন, “সমস্যা নিয়ে বহু বার উর্ধ্বতন মহলে দরবার করেছি। লাভ হয়নি। পরিস্থিতি এমন আমাকেও হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে পড়তে হবে।” পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ভারপ্রাপ্ত মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুবীর কীর্তনিয়াও সমস্যার কথা মেনে নিয়ে বলেন, “ধীরে ধীরে সমস্যাটি মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।”
পরিকাঠামোগত আরও অনেক সমস্যা রয়েছে প্রায় ৩০ বছর আগে তৈরি এই হাসপাতালে। আইসোলেশন ইউনিট নেই, চেস্ট ইউনিট নেই। অপারেশন থিয়েটারেরও অনেক যন্ত্রপাতি নেই। লেবার ওয়ার্ড থেকে অপারেশন থিয়েটার প্রায় ৫০ মিটার দূরে। বছর চারেক আগে তৈরির পর থেকে বন্ধ বার্ন ও সোয়াইন ফ্লুয়ের ওয়ার্ড দু’টি।
২০০৯ সালে হাসপাতালের দোতলায় একটি বার্ন ওয়ার্ড গড়ে তোলা হয়েছিল। খরচ হয়েছিল প্রায় ৮ লক্ষ টাকা। সেই সময়ই রাজ্যে ‘সোয়াইন ফ্লু’র সংক্রমণ দেখা দিলে এই ওয়ার্ডের পাশেই একটি বিশেষ জীবাণুু প্রতিরোধক ওয়ার্ড গড়ে তোলা হয় সংক্রামক রোগীদের রাখার জন্য। ১২ শয্যা বিশিষ্ট এই ওয়ার্ড তৈরিতেও খরচ হয়েছিল প্রায় ৮ লক্ষ টাকা। কিন্তু নির্মাণের পর থেকেই তালাবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে ওয়ার্ড দু’টি। মরচে ধরেছে শয্যাতে। হাসপাতালের সুপার হারাধন বর্মণের যুক্তি, “ওই দু’টি ওয়ার্ড পূর্ত দফতর এখনও আমাদের হস্তান্তর করেনি।” পূর্ত দফতরের আধিকারিক সঞ্জয় গুহ অবশ্য বলেন, “আমি এখানে আসার আগে কী নির্মাণ হয়েছে জানি না। তবে, এই ভাবে কোনও ভবন নির্মাণ হয়ে পড়ে রয়েছে, অথচ হস্তান্তর হয়নি বলে জানা নেই। কেউ কোনও আবেদনও করেনি। কিছু দিন আগে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তখনও কেউ এই কথা জানিয়েছে বলে স্মরণে নেই।”
|