সুস্থ হতে হাসপাতালে এসে সেখানেই ভয়াবহ সংক্রমণ। বহু ক্ষেত্রে জীবনসংশয়ও। সরকারি হাসপাতালে প্রায়শই ঘটে চলা এই ‘হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন’-এর অন্যতম কারণ হিসেবে এ বার কাঠগড়ায় উঠেছে লন্ড্রি পরিষেবা। যার প্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত সংস্থাকে সতর্ক করার পাশাপাশি হাসপাতালের কাপড়চোপড় কাচার বিষয়টিতে স্বনির্ভরতা আনার কথাও ভাবতে শুরু করেছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা।
অভিযোগ, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে রোগীর বিছানায় পাতা বা গায়ে দেওয়া চাদর-কম্বল ঠিকঠাক পরিষ্কার করা হচ্ছে না। বহু ক্ষেত্রে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময়ে রোগীকে যে গাউন পরানো হয়, পরে তা যথাযথ ভাবে জীবাণুমুক্ত না-করেই ফের ব্যবহারের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকী, এক হাসপাতাল থেকে আসা চাদর-জামাকাপড় যথাযথ প্রক্রিয়ায় না-কেচে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ।
ফলে সংক্রমিত পোশাক-আশাক থেকে রোগীর শরীরে নতুন সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে। পরিস্থিতি এমনই যে, বহু সরকারি হাসপাতালে এখন ডাক্তারেরা সরাসরি বাড়ির লোককে বলে দিচ্ছেন, রোগীকে বাঁচাতে হলে বাড়ি থেকে চাদর, জামাকাপড় নিয়ে আসুন। হাসপাতালের কাপড় নিরাপদ বহু ক্ষেত্রে নার্সরাও তেমন গ্যারান্টি দিতে পারছেন না। তাই তাঁরাও রোগীর পরিজনকে বলছেন বাড়ির পোশাক ও চাদর আনতে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এক নার্স যেমন জানাচ্ছেন, “বহু বার চাওয়ার পরে হয়তো ওয়ার্ডের রোগীদের জন্য নতুন চাদর পেলাম। ব্যবহারের পরে তা কাচতে পাঠানো হল। কিন্তু যে চাদর কেচে এল, তার নানা জায়গায় ছেঁড়া! আমাদের নতুন চাদর হয়তো তখন অন্য কোনও হাসপাতালে চলে গেছে! আর আমরা রোগীদের গালমন্দ শুনছি।” অভিযোগ, বিসি রায় শিশু হাসপাতালে এক বার শিশুরোগীদের গাউন কাচতে পাঠিয়ে নার্সরা ফেরত পেয়েছিলেন প্রাপ্তবয়স্কদের গাউন!
বিভিন্ন জেলাতেও কাপড় ধোওয়া নিয়ে এমন বহু ‘ভুল’-এর নজির। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বাস্থ্য দফতর বিশেষ তদন্তকারী দল গড়েছিল। তদন্তে সরকারি হাসপাতালের লন্ড্রি-পরিষেবাদানকারী সংস্থার গাফিলতি প্রমাণিত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য-সূত্রের দাবি। সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, “বাঘাযতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ড্রি। ওখানে শহরের সব হাসপাতালের পোশাক কাচা হয়। এক সঙ্গে অত কিছু করতে গিয়ে মাঝে-মধ্যেই সমস্যার অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। খতিয়ে দেখার পরে আমরা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সতর্ক করে দিয়েছি।”
সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি অবশ্য অভিযোগ মানতে চায়নি। তাদের বক্তব্য, দু’-একটা ক্ষেত্রে ভুল হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আকছার এমন হয় এই অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে তাদের দাবি।
স্বাস্থ্য দফতরের খবর: একেবারে গোড়ার দিকে সরকারি হাসপাতালে কাপড়চোপড় কাচার জন্য ‘ধোবি’ পদ ছিল। সময়ের সঙ্গে ‘ধোবি’ নিয়োগ কমতে শুরু করে। এখন গোটা রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে ‘ধোবি’র সংখ্যা হাতে গোনা। সেই কারণে হাসপাতালে লন্ড্রি পরিষেবায় সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে পিপিপি) দিকে ঝুঁকছে স্বাস্থ্য দফতর। কলকাতার কিছু হাসপাতালে তা চালুও হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি তেমনই এক উদ্যোগের শরিক। “আমরা চাইছি প্রতি জেলায় মেকানাইজড লন্ড্রি খুলতে।” বলছেন স্বাস্থ্য-অধিকর্তা।
লন্ড্রি পরিষেবার ফাঁকফোকড় নিয়ে বৃহস্পতিবারও এক প্রস্থ বৈঠক হয় স্বাস্থ্যভবনে। হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন সংক্রান্ত অভিযোগগুলির পিছনে এর ভূমিকা কতটা, সে নিয়ে আলোচনা হয়। বস্তুত হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশনের প্রসঙ্গেই সরকারি হাসপাতালে বস্ত্র-বিপদের ছবিটা আরও বেশি করে সামনে উঠে এসেছে। চিকিৎসকদের একাংশের মতে, সরকারি হাসপাতালে এমনিতেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের নীতি (অ্যান্টিবায়োটিক প্রোটোকল) বলে কিছু নেই। এক-এক হাসপাতালে এক-এক ধরনের সংক্রমণ বেশি। তার উপরে মূল পরিকাঠামোয় গাফিলতি থাকায় বিপদের আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজি’র এক ডাক্তারের আক্ষেপ, “পোশাক বা চাদর যথাযথ ভাবে পরিষ্কার না-হওয়ায় প্রায় সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীও সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন।” স্বাস্থ্য-কর্তারা কী বলেন?
হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধে রাজ্যে নির্দিষ্ট কর্মসূচি (ইনফেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কন্ট্রোল প্রোগ্রাম) বলবৎ থাকলেও আদতে যে তা নাম-কা-ওয়াস্তে, স্বাস্থ্যভবনের অনেকেই তা মানছেন। “পরিচ্ছন্নতার একেবারে গোড়ার কথা হল, রোগীর বিছানা, পোশাক ইত্যাদি নিয়মিত ঠিকঠাক পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করা। ডাক্তারের হাতে গ্লাভস থাকতে হবে, কয়েক ঘণ্টা অন্তর ওয়ার্ড সাফ করতে হবে। কোনওটাই পুরোপুরি মানা হয় না।” স্বীকার করছেন ওঁরা। দেশে হাসপাতালের সংক্রমণ নিয়ে কাজ করে যে সংগঠন, সেই ‘হসপিটাল ইনফেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’র সদস্যেরা জানান, রোগীর বিছানার চাদর-গাউনের পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সংক্রমণের যোগাযোগ নিবিড়। নজর রাখলে বিপদ অনেকটা ঠেকানো যাবে।
যাবে, কিন্তু কবে? সেটাই আপাতত লাখ টাকার প্রশ্ন। |