পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া আধো-অন্ধকার ঘরের এক কোণে পড়ে ছিল একটি ধারালো তলোয়ার। গায়ে লেগে থাকা রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে আগরপাড়ার মহাজাতি নগরের দাস বাড়িতে তল্লাশি চালাতে ঢুকে এই তলোয়ারটিই উদ্ধার করলেন পুলিশ অফিসারেরা। তাঁদের অনুমান, তলোয়ারটির ওজন হবে প্রায় চার কেজি। যার দু’দিকেই ধার, জাপানি সামুরাইদের মতো। পুলিশ জানাচ্ছে, নিকটাত্মীয়দের খুনের সময়ে নেপাল দাস সামুরাইদের মতোই পোশাক পরেছিল। গ্রেফতারের সময়ে তার পরনে ছিল ক্যারাটের পাজামা, হলুদ গেঞ্জি, পায়ে ঢাউস গামবুট। পকেটে ছিল বেশ কয়েকটি পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট। যা পুলিশের গাড়িতে ওঠার আগে জমায়েত হওয়া বাসিন্দাদের মধ্যে বিলিয়ে দেয় নেপাল। সেই টাকা কোথা থেকে এল, কেনই বা সে তা বিলিয়ে দিল, বুঝে উঠতে পারছেন না তদন্তকারীরা।
বুধবার বিকেলে মহাজাতি নগরের দোতলা বাড়িতে নেপালের উন্মত্ত আচরণ লক্ষ করেন পড়শিরা। দেখেন আগুনের শিখাও। পরে দমকল ও পুলিশ এসে বাড়ির ভিতর থেকে নেপালের স্ত্রী সোমা (৩৫), বৌদি রত্না (৩৮) ও ভাইপো শুভঙ্করের (১১) গলা কাটা ও আধপোড়া দেহ উদ্ধার করে। শরীরে ও গলায় ধারালো অস্ত্রের কোপ-সহ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় নেপালের ছেলে রাজা (৬) ও মেয়ে রূপাকে (১৪)। বৃহস্পতিবার হাসপাতালে মারা যায় রাজা। রূপার অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর। |
এই ঘটনায় পুলিশকে এখন ভাবাচ্ছে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। প্রথমত, নেপালের স্ত্রী-র দেহ উদ্ধার হয়েছে ঝুলন্ত অবস্থায়। সে ক্ষেত্রে তাঁকে কি খুন করে ঝোলানো হয়েছে, নাকি আত্মহত্যা করেছেন তিনি? যে অবস্থায় সোমাদেবীর দেহটি ঝুলছিল, বাইরে থেকে তার লক্ষণ দেখে পুলিশের হোমিসাইড শাখার অভিজ্ঞ অফিসারেরা আত্মহত্যার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কারণ, সাধারণত গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে যে দিকে ফাঁসের গিঁটটি থাকে, তার উল্টো দিকে মাথা হেলে পড়ে। এ ক্ষেত্রেও সোমার গলার গিঁটটি ছিল বাঁ দিকে, মাথা হেলে ছিল ডান দিকে। সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, সোমাদেবীর গলার বাঁ দিকে গভীর ক্ষত কী ভাবে এল। তাই ময়না-তদন্তের রিপোর্ট আসার আগে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে রাজি নন ওই অফিসারেরা।
তবে পুলিশের দাবি, জেরায় নেপাল জানিয়েছে, দাদা ও তাঁর পরিবারকে খুনের কথা স্ত্রীকে জানিয়েছিল সে। তার দাবি, বৌদি ও ভাইপোকে খুন করতে দেখে তার স্ত্রী নিজেই গলায় ফাঁস দেন। পরে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সে স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের গলায় কোপ বসিয়ে দেয়।
পাশাপাশি, এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়েও সংশয়ে পুলিশ। পুলিশ সূত্রের খবর, জেরায় বাড়ি-সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের কথাই বারবার জানিয়েছে নেপাল। দাদা ও তাঁর পরিবারের উপরে যে তার পুরনো রাগ ছিল, সে কথাও স্বীকার করেছে সে। পুলিশকে পারিবারিক বিবাদের কথা জানিয়েছেন নেপালের দাদা গোপাল দাস-ও। এ দিনই গোপাল খড়দহ থানায় ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটি খুনের মামলা দায়ের করেছেন। তাঁর অভিযোগ, নেপাল পুরোপুরি পরিকল্পিত ভাবেই খুন করেছে।
পুলিশের দাবি, নেপাল জানিয়েছে, দু’ভাইয়ের ঝগড়ায় বাবা তেজেন্দ্রনারায়ণবাবু বড় ছেলে গোপালকেই সমর্থন করতেন। নেপালের আশঙ্কা ছিল, মায়ের নামে থাকা বাড়ি ও লেদ কারখানা দাদার নামেই লিখে দেওয়া হবে। সম্ভবত এর ফলেই দাদা ও তাঁর পরিবারের উপরে রাগ জমেছিল তার।
তবে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের তত্ত্ব অবশ্য পুরোপুরি মেনে নিতে পারছেন না তদন্তকারীরা। তাঁরা জানান, দু’ভাইয়েরই বাজারে প্রচুর দেনা ছিল। লেদ কারখানার অবস্থাও ভাল ছিল না। ফলে ওই সম্পত্তি নিয়ে কী লাভ হত, বুঝে উঠতে পারছেন না তদন্তকারী অফিসারেরা। পাশাপাশি, সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে হলে দাদা বা বাবাকে কেন ছাড় দিল নেপাল, তা নিয়েও ধন্দে রয়েছে পুলিশ।
বুধবার রাতে জেরার পরে নেপালও অসুস্থ হয়ে আর জি কর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ দিন ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের এক কর্তা জানান, দাস বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তলোয়ারের পাশাপাশি একটি বঁটির ফলাও মিলেছে। পুলিশের দাবি, পরিকল্পনামাফিক খুন করার জন্য নেপাল গত এক বছর ধরে বাড়িতে বসে ওই তলোয়ার বানিয়েছিল বলে জেরায় স্বীকার করেছে।
সম্পত্তি নিয়ে বিবাদই হোক বা বড় ভাইয়ের উপরে রাগ, বাড়ির বাচ্চাদের নেপাল খুন করল কেন, তা-ও ভাবিয়ে তুলেছে তদন্তকারীদের।
পুলিশের দাবি, গোপাল বলেছেন, “ভাই খুব রগচটা। শৌচাগারে জল দেওয়া বা ঘরের সামনে জুতো রাখার মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়েও গোলমাল বাধাত। গত কয়েক মাস ধরেই দেখছিলাম, আমার স্ত্রী ও ছেলের উপরে ওর রাগ বাড়ছিল।”
পুলিশ আরও জানিয়েছে, এ দিন রূপা কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। তবে আকারে ইঙ্গিতে সে জানিয়েছে, তাঁদের ঠাকুর্দার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ভাল ছিল না। ঠাকুর্দা তাঁদের তেমন ভাবে যত্নও করতেন না। পরে রূপা চিকিৎসকদের কাছে কাগজ ও কলম চেয়েছে। সে লিখে কিছু জানাতে চায় বলে ডাক্তারেরা জানান।
তদন্তকারীদের ধারণা, নেপাল দীর্ঘ দিন ধরেই মানসিক অবসাদে ভুগছিল। বুধবারের ঘটনা তারই প্রতিফলন। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পারিবারিক বিবাদের মতো বিষয়ও। এক পুলিশকর্তা বলছেন, “মানসিক রোগের শিকার না হলে কিম্ভুত পোশাক পরে এই নৃশংস হত্যালীলা চালানো অসম্ভব।”
এ দিন সকালে মহাজাতিনগরে গিয়ে দেখা যায়, দাস বাড়ি সুনসান। ভিতরে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। হাজির হয়েছে দমকলও। বাইরে ইতিউতি ভিড় স্থানীয় বাসিন্দাদের। কেন এই খুন, তা নিয়ে এখনও ধন্দ কাটেনি তাঁদেরও। বিকেলে বাড়িতে যান গৃহকর্তা তেজেন্দ্রনারায়ণ দাস ও তাঁর স্ত্রী নীহারকণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ তাঁদের ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখালেও কয়েক জন উদ্ধার করে নিয়ে যান। পরে তেজেন্দ্রনারায়ণ বলেন, “ছেলে যে এমন করতে পারে, তা আগে আঁচ করতে পারিনি। আমি চাই, ওর মৃত্যুদণ্ড হোক।” একই দাবি নেপালের মা নীহারকণা দেবীরও।
|