ছেলে-মেয়েকেও খুনের চেষ্টা
স্ত্রী-বৌদি-ভাইপোকে কুপিয়ে মেরে বাড়িতে আগুন
বাড়ির দোতলায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তার মধ্যে ধারালো তলোয়ার হাতে ছোটাছুটি করছেন বাড়ির ছোট ছেলে!
বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ দৃশ্যটি দেখে আঁতকে উঠেছিলেন আগরপাড়ার মহাজাতিনগরের কিছু বাসিন্দা। তখনও ওঁরা ঘটনার নৃশংসতা আঁচ করতে পারেননি। পারলেন, যখন দমকল ঢুকে দুই মহিলা ও একটি শিশুর গলাকাটা-আধপোড়া দেহ উদ্ধার করল। পুলিশ জানায়, গলা কেটে খুন করে তাঁদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও একটি শিশু ও এক কিশোরীকে গলা কেটে মারার চেষ্টা হয়েছে। তারা পড়ে ছিল সংজ্ঞাহীন হয়ে।
প্রাথমিক ভাবে পুলিশ জানাচ্ছে, নেপাল দাস নামের বছর চল্লিশের ওই ব্যক্তি নিজের স্ত্রী সোমা (৩৫), বৌদি রত্না (৩৮) ও ভাইপো শুভঙ্কর (১১)-কে গলা কেটে খুন করেন। পরে তাঁদের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন। নিজের ছেলে রাজা (৬) এবং মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়ে রূপা (১৪)-কেও তিনি গলা কেটে ও শ্বাসরোধ করে মারার চেষ্টা করেছিলেন বলে পুলিশের ধারণা। দু’জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আর জি কর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। নেপালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার আগে পাড়াপড়শিরা তাঁকে পেটায়। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় সিংহ বলেন, “কী কারণে খুন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। ধৃতকে জেরা করা হচ্ছে।”
হত্যাকাণ্ডের পরে অগ্নিদগ্ধ ঘর।
জেরায় আপাতত কী জানা যাচ্ছে?
তদন্তকারী সূত্রের খবর: দাদা ও তাঁর পরিবারের উপরে রাগ থাকার কথা নেপাল স্বীকার করেছেন। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক কর্তার দাবি, দাদা-বৌদিকে খুনের মতলব তাঁর অনেক দিন ধরেই ছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। এ জন্য তলোয়ারও বানিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের উপরে তাঁর আক্রোশ কেন, ব্যাখ্যা মেলেনি। বাজারে নেপালের বেশ কিছু দেনা রয়েছে। রাতে জেরার পরে নেপালকে লক-আপে নিয়ে যাওয়ার সময় থানার বাইরে জড়ো হওয়া পড়শিরা তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন বলে পুলিশের অভিযোগ। পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতাকে তাড়া করে। রাতে অসুস্থ হয়ে পড়ায় নেপালকে আর জি করে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাঁর দাদা গোপালকেও। ঘটনার সময়ে তিনি বাড়ি ছিলেন না।
স্থানীয় সূত্রের খবর: মহাজাতিনগরের সবিতা অপটিক্সের গলিতে পুরনো দোতলা বাড়িতে থাকে দাস পরিবার। একতলায় থাকেন গৃহকর্তা তেজেন্দ্রনারায়ণ দাস ও কর্ত্রী নীহারকণাদেবী। দোতলায় বড় ছেলে গোপাল ও ছোট ছেলে নেপালের পরিবার। গোপাল বাবার লেদ কারখানা সামলান, নেপাল টিভি মিস্ত্রি। এ দিন ঘটনার সময়ে তেজেনবাবুও বাড়ি ছিলেন না। ছোট ছেলের উন্মত্ত মূর্তি দেখে নীহারকণাদেবী একতলার একটি ঘরে লুকিয়ে ছিলেন। পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। তিনি জানান, নিধনপর্ব চলাকালীন তিনি ছেলেকে নিরস্ত করতে গিয়েছিলেন। নেপাল মায়ের চোখেমুখে কেরোসিন ছিটিয়ে দেন। ভয়ে তিনি একতলায় চলে আসেন।
পুলিশের কাছে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন প্রতিবেশী।
পড়শিরা কী দেখেছিলেন?
বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ কয়েক জন প্রতিবেশী দাস-বাড়িতে আগুন দেখতে পান। দেখেন, নেপাল তলোয়ার হাতে উন্মত্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন। পড়শিরা বাড়িতে ঢুকতে যান। তাঁরা জানান, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে নেপাল তাঁদের দিকে কেরোসিন ছুড়তে থাকেন, পরে ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। কয়েক জন জলের পাইপ বেয়ে ওঠার চেষ্টা করায় নেপাল তাঁদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগানোর হুমকি দেন। দমকল আসে। তত ক্ষণে আগুন ছড়িয়েছে দোতলা জুড়ে। আশপাশের বাড়ির ছাদ থেকে বাসিন্দারাও জল ঢালতে থাকেন। দমকলকর্মীরা তালা ভেঙে ঢুকে দোতলার একটি ঘরে রত্না ও শুভঙ্করের আধপোড়া দেহ দেখতে পান। অন্য ঘরে গলায় ফাঁস দেওয়া সোমার ঝুলন্ত দেহ। প্রত্যেকের গলায় ধারালো অস্ত্রের কোপ। ঘরের পাশে পড়ে ছিল অচেতন রাজা-রূপা। তাদেরও গলা ও শরীরে কোপ। দু’জনের গলায় তার পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা হয়েছিল। রূপার ঘাড় ভেঙে গিয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর।
পুলিশের অনুমান, নেপাল প্রথমে বৌদি ও ভাইপোকে খুন করেন। পরে স্ত্রীকে মেরে ঝুলিয়ে দেন। নিজের ছেলেমেয়েকেও রেয়াত করেননি। শেষে ঘরে আগুন ধরান। জানলার পর্দা ছিঁড়ে কেরোসিন ঢেলে আগুনের তীব্রতা বাড়ানোরও চেষ্টা করেন। পুলিশের অনুমান, সকলকে মেরে নিজেও মরতে চেয়েছিলেন তিনি। সন্ধ্যায় দেখা যায়, গোটা ঘর আগুনে পুড়ে কালো। মেঝেয় চাপ চাপ রক্ত। আগুনের তাপে দলা পাকিয়ে গিয়েছে একটি সাইকেলও।
খুনের কারণ সম্পর্কে পুলিশ রাত পর্যন্ত নিশ্চিত হতে না-পারলেও বাসিন্দাদের ইঙ্গিত পারিবারিক অশান্তির দিকেই। তাঁরা জানান, গোপাল-নেপালের মধ্যে বাড়ির দখলদারি নিয়ে হামেশাই ঝামেলা হত। অনেক সময়ে পড়শিরা এসে থামাতেন। তাঁদেরই এক জন, চিকিৎসক সুব্রত দাস বলেন, “বেশ ক’বার দু’ভাইয়ের গণ্ডগোল মিটিয়েছি। আজও আগুন নেভাতে গিয়েছিলাম। তবে এমন কাণ্ড হতে পারে, ভাবিনি।” রাতে হাসপাতালে তেজেনবাবুও বলেন, “দুই ছেলের মধ্যে গণ্ডগোল ছিল। বৌয়ে-বৌয়েও ঝামেলা চলত।” বাসিন্দারা জানান, এ দিন সকালে গোপাল-নেপালের মধ্যে এক প্রস্ত বচসা হয়। পরে গোপাল কাজে বেরিয়ে যান। দুপুরে বৌদির সঙ্গে ফের ঝামেলা বাধে নেপালের।
তার পরে বিকেলে হত্যালীলা। ‘ঘরোয়া বিবাদের’ এ-হেন পরিণতি দেখে হতবাক মহাজাতিনগরের বাসিন্দারা। তাঁদের অনেকেরই দাবি, নেপাল বদমেজাজি হলেও মানসিক ভাবে মোটামুটি সুস্থ ছিলেন। তবে পাড়ায় খুব একটা মেলামেশা করেন না। কী ধরনের মানসিক অবস্থায় পৌঁছলে এক জন এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন?
মনোচিকিৎসক প্রথমা চৌধুরীর ব্যাখ্যায়, কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের রাগ নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এটা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা পরিভাষায় ইমপালসিভ কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার। এমন মানুষেরা অল্পেতেই অসম্ভব রেগে জিনিসপত্র ভাঙতে বা ছুড়তে থাকেন, যা মুখে আসে বলতে থাকেন। হুঁশ ফিরলে ওঁদের আফসোস হয়। কিন্তু তত ক্ষণে যা হওয়ার হয়ে যায়। রাগটা এঁদের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আসে। বাগ মানাতে না-পারলে সেই ক্রোধ মাত্রা ছাড়িয়ে এমন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
সেই বিপর্যয়েরই বুঝি সাক্ষী রইল বুধবারের আগরপাড়া।

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.