|
|
|
|
তাম্রলিপ্তের বিলুপ্তি-স্রোতেই কি ডুবছে হলদিয়া, উদ্বেগ |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
সপ্তগ্রাম, তাম্রলিপ্ত, সালকিয়া, বেতড়...। বাংলার বিলুপ্ত বন্দরের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন কি হতে চলেছে হলদিয়া?
দীর্ঘস্থায়ী নাব্যতা সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে সংশয়টি এখন রীতিমতো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে হলদিয়ার আকাশে। আশঙ্কা জেগেছে, পলির গ্রাসে তাম্রলিপ্ত-সপ্তগ্রাম থেকে শুরু করে সাঁকরাইল-হিজলির মতো প্রাচীন বংলার বহু বন্দর যে ভাবে শুকিয়ে গিয়েছে, সে ভাবে এক দিন মজে যাবে হলদিয়াও। উল্লেখ্য, বিলুপ্ত ওই সব বন্দরের অবস্থান ছিল নদীর পশ্চিম তীরে, যেখানে জোয়ারের টানে সমুদ্রের পলি এসে জমে বিপুল হারে। ফলে নাব্যতা কমতে কমতে এক সময়ে বন্দরগুলোর অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে। হলদিয়াও পশ্চিম পাড়ে। এমনকী, শালুকখালিতে যেখানে হলদিয়ার দ্বিতীয় বন্দরটি নির্মাণের কথা হচ্ছে, সেটাও নদীর পশ্চিম তীরে।
এবং শালুকখালির প্রস্তাবিত পিপিপি প্রকল্পে এখনও রাজ্যের কপালে কোনও বেসরকারি লগ্নি জোটেনি। প্রথম বারের আহ্বান বিফলে যাওয়ায় বন্দর-কর্তৃপক্ষ টেন্ডারের সময়সীমা বাড়িয়েছিলেন। বুধবার দ্বিতীয় দফার মেয়াদও ফুরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু কোনও লগ্নিকারী এসে বিড ডকুমেন্টও কিনে নিয়ে যাননি। বাধ্য হয়ে টেন্ডার পেশের সময়সীমা আরও দু’সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। তাতেও খুব একটা লাভ হবে বলে আশা করতে পারছেন না বন্দর-কর্তাদেরই অনেকে। |
|
তা হলে কি লগ্নিকারীরা আঁচ পেয়েছেন যে, হলদিয়ার মতোই শালুকখালিরও একই দশা হবে?
বস্তুত এমনটাই মনে করছেন কেন্দ্রীয় অপ্রচলিত বিদ্যুৎ মন্ত্রকের জাতীয় স্তরের পর্যবেক্ষক প্রীতিতোষ রায়। তাঁর ব্যাখ্যা: ভাগীরথী তথা হুগলি নদীর পশ্চিম পাড়ে গড়ে ওঠা বাংলার একদা বিখ্যাত বন্দরগুলোর সবই কালক্রমে পরিত্যক্ত হয়েছে। কেননা পশ্চিম পাড়ে বেশি পলি জমে। তুলনায় পূর্ব তীরে কম পলি জমে বলে ১৪৩ বছরের কলকাতা বন্দর এখনও টিকে রয়েছে। প্রীতিতোষবাবুর দাবি: পশ্চিমের পলি-দুর্ভাগ্যের গ্রাসে কলকাতার আগেই হলদিয়া বন্দর শুকিয়ে যাবে। হুগলির মোহনায় ড্রেজিং করে পলি তুলে সাময়িক লাভ হলেও তাতে সমস্যার পাকা সুরাহা অসম্ভব। কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষের তথ্যও বলছে, বছর কয়েক আগে যে শালুকখালিতে ৯ মিটার নাব্যতা দেখে হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন কর্তারা, এখন সেখানে নাব্যতা কমে দাঁড়িয়েছে সাত মিটারে।
পশ্চিমবঙ্গের নদ-নদী নিয়ে প্রীতিতোষবাবুর লেখা গ্রন্থের এ হেন তত্ত্ব জাহাজ মন্ত্রক তো বটেই, রাজ্যের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের অন্দরেও উদ্বেগ তৈরি করেছে। উদ্বেগ যে অমূলক নয়, ন্যাশনাল শিপিং বোর্ডের চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন পি ভি কে মোহন-ও তা মানছেন। “সত্যি বলতে কী, এই সমস্যার কারণেই সাগরে নতুন বন্দর তৈরির পরিকল্পনা। পাশাপাশি বাক্সবন্দি পণ্য খালাসের লক্ষ্যে ডায়মন্ড হারবারে নতুন টার্মিনাল তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখান থেকে বার্জে চাপিয়ে পণ্য নিয়ে যাওয়া হবে হলদিয়া ও কলকাতায়।” জানাচ্ছেন মোহন।
জাতীয় স্তরের পর্যবেক্ষক তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি সংস্থা (ওয়েবরেডা)-র পরিচালন সমিতির সদস্য প্রীতিতোষবাবু তাঁর ‘বাংলার হারানো নদীর ইতিকথা’ বইয়ে লিখেছেন, বড় জাহাজ চলাচলের স্বার্থে নদীর মোহনায় যথেষ্ট গভীরতা দরকার। অথচ পলি জমে জমে হলদিয়া বন্দর সেই গভীরতা হারাতে বসেছে, নিছক ড্রেজিং করে যা শুধরানো যাবে না। কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের এক প্রাক্তন কর্তার মুখেও এই আশঙ্কার প্রতিধ্বনি “জাহাজ ঢোকার জন্য ১২ মিটার নাব্যতা থাকবে ধরে হলদিয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু লাগাতার ড্রেজিং সত্ত্বেও ২০০৮-এ নাব্যতা এসে দাঁড়ায় ৯ মিটারে। পাল্লা দিয়ে জাহাজ আসা ও পণ্য খালাসের পরিমাণ কমেছে।” কর্তাটি বলেন, “২০১০-এ একটা সময়ে তো নাব্যতা পাঁচ মিটারে দাঁড়িয়েছিল! তৎকালীন জাহাজমন্ত্রী টিআর বালু হলদিয়াকে বন্দরের তালিকা থেকেই ছেঁটে ফেলতে চেয়েছিলেন!”
মন্ত্রকের খবর: বালুর পরিকল্পনা ছিল বড় জাহাজ হলদিয়ার বদলে ভিড়বে গিয়ে ওড়িশার ধামরা বন্দরে। তার পরে বার্জে চাপিয়ে মাল আনা হবে হলদিয়ায়। সে প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু অথর্র্ মন্ত্রক ইতিমধ্যে তুলে দিয়েছে আর একটা অতি গুরুতর প্রশ্ন মাল খালাসের বহর চোখে পড়ার মতো কমে যাওয়া সত্ত্বেও হলদিয়ায় ড্রেজিং-ভর্তুকি বাবদ কেন্দ্র ফি বছর পাঁচশো কোটি টাকা গুণবে কেন?
এমতাবস্থায় সঙ্কট গভীরতর হয়েছে। কেন্দ্রীয় ড্রেজিং-ভর্তুকির অর্থ হলদিয়া বন্দরের বড় সম্বল। তা ছাঁটাই হলে বন্দরের অস্তিত্ব আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে বলে জাহাজি মহলের একাংশের ধারণা। বন্দর-সূত্রের খবর: ভর্তুকি না-থাকলে ২০০৯ থেকেই হলদিয়া লোকসানের মুখ দেখত। নাব্যতা-সঙ্কট মোকাবিলায় কলকাতা বন্দরের তদানীন্তন চেয়ারম্যান এমএল মিনা স্থির করেছিলেন, সমুদ্রের স্যান্ডহেড্সে নোঙর করা বড় জাহাজ থেকে পণ্য নামিয়ে তা ছোট জাহাজে চাপিয়ে হলদিয়ায় আনা হবে। ওড়িশা তাতে আপত্তি তোলে, মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে। মুকুল রায় জাহাজ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরে হলদিয়া নিয়ে আশার সঞ্চার হয়। ভর্তুকির অনিশ্চয়তা কাটে। তখনই হলদিয়ার কাছে শালুকখালি ও ডায়মন্ড হারবারে পণ্য খালাসের নতুন দু’টো ব্যবস্থা তৈরির সম্ভাবনা যাচাই করতে গড়া হয় বিশেষজ্ঞ কমিটি। শালুকখালির প্রস্তাবিত যৌথ উদ্যোগ প্রকল্পে এখনও বিনিয়োগ না-মিললেও শিপিং বোর্ডের চেয়ারম্যানের দাবি, “ডায়মন্ড হারবারে লগ্নি পেতে সমস্যা হবে না। বড় বড় শিল্প সংস্থা আগ্রহ দেখিয়েছে।” প্রসঙ্গত, ডায়মন্ড হারবারের অবস্থান নদীর পূর্ব পাড়ে। অর্থাৎ পলির দৌরাত্ম্য তুলনায় কম। ফলে সম্ভাবনা বেশি। পশ্চিমের হলদিয়ার সামনে কি সম্ভাবনার কোনও দরজা খোলা নেই?
প্রীতিতোষবাবু এ জন্য মূলত রূপনারায়ণ সংস্কারে জোর দিচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য: হুগলি নদী রূপনারায়ণে মেশার পরে একেবারে ৯০ ডিগ্রি বেঁকে গিয়েছে। রূপনারায়ণ আসছে সরলরেখায়। ফলে ডায়মন্ড হারবারে হুগলির তুলনায় রূপনারায়ণের স্রোতের প্রভাব বেশি। তাই রূপনারায়ণের গভীরতা বাড়িয়ে যদি জলের গতি বাড়ানো যায়, তা হলে সেই খরস্রোতে পলি সরে যেতে পারে। ঠিক যেমন জলের তোড়ে নর্দমা সাফ হয়।
কিন্তু এখানেও সমস্যা! কোলাঘাট রেল-সেতু নির্মাণকালে রূপনারায়ণের মধ্যে পিলার গাঁথা হয়েছে, যার জেরে নদীখাত মজে আসছে। স্তম্ভগুলোর আশপাশেই পলি জমছে। পরের দু’টো সেতু আরও সর্বনাশ ডেকে এনেছে। প্রীতিতোষবাবুর দাওয়াই: রূপনারায়ণের সঙ্গে মুণ্ডেশ্বরী-কংসাবতী-হলদিরও গভীরতা বাড়াতে হবে। সম্মিলিত প্রভাবে হুগলিতে স্রোত বাড়বে, পলি সরবে।
তবে এ জন্য চাই বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা। আগে কপিল ভট্টাচার্যের মতো নদী-বিশেষজ্ঞেরা একই মত দিয়েছিলেন। কাজের কাজ হয়নি। এখনও রাজ্য বা কেন্দ্র কতটা উদ্যোগী হবে, তা নিয়ে সংশয় যথেষ্ট। তা হলে উপায় কী? জাহাজ মন্ত্রকের কর্তাদের মতে, গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে সেখান থেকে বার্জে পণ্য নিয়ে আসাটাই আপাতত একমাত্র উপায়। |
পুরনো খবর: হলদিয়ায় ড্রেজিংয়ে ভর্তুকির দিন কি শেষ, উদ্বেগ বন্দরে |
|
|
|
|
|