|
|
|
|
সব চাষির সম্মতির দাবি, অবাক আলিমুদ্দিন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
জমি নীতি নিয়ে ফের বিতর্ক সিপিএমের অন্দরে।
গত কাল জয়রাম রমেশের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় এবং আজ সর্বদল বৈঠকে সিপিএম নেতারা দাবি করেছেন, বেসরকারি শিল্প সংস্থা এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের জন্য জমি নিলে ১০০% জমি মালিকের সম্মতি নিতে হবে। এই দাবিতে বিস্ময় প্রকাশ করে দলীয় নেতাদেরই একাংশ বলছেন, “তা হলে তো আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতির সঙ্গে আমাদের অবস্থানের কোনও ফারাক থাকছে না! এই অবস্থান নিলে শিল্পায়ন করাই যাবে না।”
বাম আমলের শেষ পর্যায়ে শিল্পায়নের ব্যাপারে তৎপর হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। জমি অধিগ্রহণও শুরু করেছিল তাঁর সরকার। কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনার পরে জমি নীতি নিয়ে সিপিএমের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। সেই বিতর্ক এখনও চলছে। কারও কারও মতে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সাবধানী হওয়া দরকার। বুদ্ধবাবু, নিরুপম সেনদের আবার মত, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে যা-ই হোক না কেন, জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে বেশি কট্টরবাদী অবস্থান নিলে শিল্পায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে। জমি বিল নিয়ে দলের সাম্প্রতিক দাবি শুনে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম নেতারা বলছেন, অতিরিক্ত কৃষক দরদী হতে গিয়ে দল আসলে শিল্পবিরোধী অবস্থান নিয়ে ফেলছে। রাজ্যের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “একশো ভাগ কৃষকের সম্মতি নিয়ে জমি অধিগ্রহণ আসলে সোনার পাথরবাটি। তা হলে ভালই হয়। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়।”
ঘটনা হল, এই বাস্তবটা মেনে নিচ্ছেন জয়রামের কাছে দাবি তোলা সিপিএম নেতারাও। গত কাল সিপিএম সদর দফতর এ কে গোপালন ভবনে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হাজির পলিটব্যুরো সদস্য এস রামচন্দ্রন পিল্লাই বলেন, “আমরা চাই, উন্নয়নের সুফল সকলেই পাক। জমির সব মালিকের সঙ্গে দর কষাকষি হলে সকলেই উন্নয়নের ভাগ পাবে। বিশেষ করে যাঁদের কাছে জমিটাই এক মাত্র আয়ের উৎস, তাঁদের জন্য এটা খুবই জরুরি। কিন্তু বাস্তবে যে এটা সমস্যা হবে, তা আমরা জানি। তাই ১০০% সম্মতির দাবি জানালেও আমরা এটা নিয়ে জোরাজুরি করছি না।” |
|
কারিগর: জমি বিল নিয়ে সর্বদল বৈঠকে জয়রাম রমেশ। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই |
তা হলে এমন দাবি তোলা
হল কেন?
দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার ব্যাখ্যা, “আসলে দর কষাকষির সময় একটু বেশি করে দাবি জানাতে হয়। তা হলে অন্তত ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ হয়।” সেই কৌশলেই সিপিএম বর্গাদারদের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি আদায় করে নিয়েছে বলে তাঁর দাবি।
তবে ব্যাখ্যা যা-ই হোক, সিপিএমের অন্দরমহলের খবর, জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে দলের অবস্থান নিয়ে বিতর্কের যে মীমাংসা হয়নি, এই ঘটনা তারই প্রমাণ। পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের কৃষকসভাতেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের জন্য কত শতাংশ কৃষকের সম্মতি নেওয়ার দাবি তোলা হবে, দফায় দফায় বৈঠক করেও তার মীমাংসা হয়নি। তাই আরও আলোচনার পথ খোলা রাখা হয়েছিল। এস আর পিল্লাই এই কৃষকসভারই সর্বভারতীয় সভাপতি।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে জমি প্রশ্নে নির্দিষ্ট অবস্থান নেওয়া জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া, সংসদে যখন বিল আসবে, তখন সিপিএম কী সংশোধনী দেবে, ভোটাভুটি চাইবে কি না, তা-ও ঠিক করতে হবে। তাই মে মাসে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পর ফের কৃষকসভার বৈঠক ডাকা হয়েছে।
সরকারি বিলে বলা হয়েছে, বেসরকারি শিল্পের জন্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে ৮০% জমির মালিকের সম্মতি লাগবে। যৌথ উদ্যোগে প্রকল্পের জন্য অন্তত ৭০% কৃষকের সম্মতি প্রয়োজন। গত কাল জয়রামের সঙ্গে বৈঠকে সীতারাম ইয়েচুরি, পিল্লাই ও বাসুদেব আচারিয়া দাবি করেন, দু’টি ক্ষেত্রেই ১০০% জমি মালিক বা কৃষকের সম্মতি নিয়ে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। আজ সর্বদলীয় বৈঠকেও দলের তরফে বাসুদেব আচারিয়া সেই দাবি তুলেছেন। এর আগে জমি বিলে সিপিএমের তরফে যে সংশোধনী আনা হয়েছিল, সেখানেও একশো ভাগ কৃষকের সম্মতির জন্য দাবি জানানো। যে দাবি শুনে জয়রাম জানিয়ে দেন, সব কৃষকের সম্মতি নিতে গেলে কোনও শিল্প হবে না।
পশ্চিমবঙ্গের নেতারাও জয়রামের মতেরই শরিক। তাঁদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে জমির মালিকানা বহু খণ্ডে বিভক্ত। গুজরাতে যে পরিমাণ জমির
মালিক ৩০০ জন, পশ্চিমবঙ্গে সেই একই পরিমাণ জমির মালিক ১৩ হাজার। ফলে কোনও ভাবেই সকলের সম্মতি নিয়ে জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব নয়। এই একই কারণে জমি অধিগ্রহণে সরকারের ভূমিকা থাকাও জরুরি বলে তাঁদের মত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমি অধিগ্রহণে সরকারের কোনও রকম ভূমিকারই বিরোধী। তাতে আপত্তি তুলে বুদ্ধবাবু, নিরুপমবাবুদের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের যাবতীয় সম্ভাবনা কার্যত শেষ করে দিচ্ছেন। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দাবি শুনে রাজ্যের নেতারা বিস্মিত। পলিটব্যুরো সদস্য তথা রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন বলেন, “আমরা বরাবরই সরকারি ভূমিকার প্রয়োজনের কথা বলেছি। কিন্তু একশো শতাংশ সম্মতির দাবি কেন ও কী ভাবে জানানো হয়েছে, তা নিয়ে কথা বলতে হবে।” জমি বিল নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির তরফে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে যে দাবিদাওয়া পেশ করা হয়েছিল, তাতে এমন কিছু ছিল না বলে জানাচ্ছেন নিরুপমবাবু। |
|
কিন্তু সিপিএমের কট্টরপন্থীদের মতে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ফলে দলের গায়ে কৃষক-বিরোধী তকমা লেগেছে। তা থেকে বেরোতে জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে কড়া অবস্থান নিতে হবে। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের ভরাডুবির পরে বিজয়ওয়াড়ায় দলের বর্ধিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছিল। সেখানে পেশ করা দলিলে বলা হয়, কৃষকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঊর্বর জমি অধিগ্রহণের কড়া বিরোধিতা করতে হবে। বুদ্ধবাবুর অনুগামীরা এই অবস্থান মানতে নারাজ। তাঁদের মতে, জমির প্রশ্নে বেশি কট্টর অবস্থান নিলে সিপিএম শিল্পবিরোধী বলে জনমানসে বার্তা যাবে। তাই গৌতম দেবের মতো নেতারা বিজয়ওয়াড়ার বৈঠকে বলেছিলেন, এই দলিল বাস্তবসম্মত নয়। দলের অনেকের মতে, এমনিতেই মালিক, বর্গাদার, ভাগচাষিকে ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন দিয়ে জমি অধিগ্রহণ কঠিন। আবার একশো ভাগ সম্মতি নিতে গেলে অধিগ্রহণ একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে।
|
যে যেখানে দাঁড়িয়ে |
|
• অধিগ্রহণের বদলে কৃষকদের থেকে লিজ চুক্তিতে জমি নেওয়া হোক
• ৫.৯.১১-র পর হস্তান্তর হওয়া জমি অধিগ্রহণে মূল কৃষককেও ক্ষতিপূরণ |
|
• শুধু পুনর্বাসন নয়, বর্গাদারদের ক্ষতিপূরণও দিতে হবে
• সড়ক, রেলের জন্য জমি নিলে একই হারে ক্ষতিপূরণ-পুনর্বাসন |
|
• জমি অধিগ্রহণে সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধী। তবে চায় বিল পাশ হোক |
|
পুরনো খবর: কেন্দ্রের জমি বিল নিয়ে বাধা এ বার সিপিএম |
|
|
|
|
|