জমি বিলের বিরোধিতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক বিন্দুতে সিপিএম!
দুই দলের বিরোধিতার ক্ষেত্র অবশ্য আলাদা। মমতা যেখানে জমি অধিগ্রহণে সরকারের ভূমিকার বিরোধী, সিপিএমের সেখানে আপত্তি পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ নিয়ে। তাদের বক্তব্য, যে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের প্রস্তাব কেন্দ্রের প্রস্তাবিত বিলে করা হয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। পার্টি কংগ্রেসে প্রস্তাব পাশ করে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সেই প্রস্তাবিত জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পুনর্স্থাপন বিলটির প্রবল বিরোধিতা করেছে। এবং ওই বিলের বর্তমান খসড়া বাতিল করে নতুন খসড়া তৈরির দাবিও তোলা হয়েছে প্রস্তাবে।
ইউপিএ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরিক তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার ‘আপত্তি’তেই মূলত এই সংক্রান্ত নতুন আইন সংসদে এখনও পাশ হয়নি। তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে সিপিএমের যুক্তির ফারাক অবশ্যই আছে। কিন্তু মূল অবস্থানে দুই শিবিরই এক বিন্দুতে বর্তমান চেহারায় ওই বিল পাশ করানো চলবে না। তৃণমূল নেত্রী পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছেন জমি আন্দোলনে ভর করে। আর সিপিএম সেই প্রশ্নেই হাত পুড়িয়েছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক কারণেই ‘ঝুঁকি’ নিতে চাইছে না রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তাবের নেপথ্যে সেই ‘বিবেচনা’ই কাজ করেছে বলে দলের একাংশের বক্তব্য।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এ বারের পার্টি কংগ্রেসের চার দিন পেরিয়ে গেলেও বিগত কয়েক বারের মতো সিপিএম এখনও সরাসরি শিল্পায়নের পক্ষে কোনও প্রস্তাব নেয়নি। শিল্প ও বণিক মহলের একাংশের আশঙ্কা, জমির প্রশ্নে সিপিএম ক্রমাগত ‘স্পর্শকাতর’ অবস্থান নিতে থাকলে এবং শাসক হিসেবে মমতাও তাঁর ঘোষিত অবস্থান থেকে না-সরলে রাজ্যের শিল্পায়নের আকাশ থেকে সংশয়ের মেঘ কাটবে না। ওই মহলের মতে, সম্প্রতি রাজ্য সরকারের তরফে বিধানসভায় ভূমি সংস্কার ও জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত বিল পাশ করানো যদি প্রথম ‘ইতিবাচক’ পদক্ষেপ হয়, তা হলে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাব তার বিপরীত ইঙ্গিত বহন করছে। বিশেষ করে তাঁরা যখন ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের পরিমাণ আরও বাড়ানোর কথা বলছেন।
এমনিতেই কেন্দ্রের প্রস্তাবিত বিলে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন বাবদ যে পরিমাণ অর্থ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবে কতটা সম্ভব, তাই নিয়েই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। রাজ্যের প্রস্তাবিত বিলটিও যে বিধানসভায় এখনও পেশ করা সম্ভব হয়নি, তার পিছনে এটি একটি কারণ। সরকারি মহে লই প্রশ্ন উঠেছে, এই সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গেলে একটি জমিদাতা পরিবারকে যা দিতে হবে, তা সরকারের কোনও দফতরের পক্ষে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। এ বার ক্ষতিপূরণ আরও বাড়ানোর দাবি উঠলে পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে, তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় শিল্পমহল। যদিও সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বক্তব্য, তাঁদের অবস্থান কোনও ভাবেই শিল্পায়নের পক্ষে ‘বাধা’ হবে না। দলের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির কথায়, “শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ চলবে না এমন কোনও অবস্থান আমরা নিইনি। আমরা জমিহারাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দিকটা নিশ্চিত করার কথা বলছি।” |
‘ভূমি সংস্কারের দাবি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি শনিবার পার্টি কংগ্রেসে পেশ করেছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। বিগত বাম মন্ত্রিসভায় পঞ্চায়েত দফতরের দায়িত্বে থাকা এবং দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে জমি-কেন্দ্রিক ঘটনাবলী ও সমস্যা সম্পর্কে যিনি সম্যক অবহিত। ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়েই সূর্যবাবুর পেশ করা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১৮৯৪ সালের ‘দানবীয়’ জমি অধিগ্রহণ আইন বদলে প্রস্তাবিত যে আইনের কথা বলা হচ্ছে, তাতে ‘বলপূর্বক অধিগ্রহণে’র মুখে কৃষকের জন্য পর্যাপ্ত ‘রক্ষাকবচ’ নেই। প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছে, জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিভিন্ন স্তরে ১৬টি আইনের কথা উল্লেখ করে ওই বিলে বেশ কিছু ‘ছাড়’ দিতে চাওয়া হয়েছে। যার ফলে খনি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড), রেল বা জাতীয় সড়কের জন্য জমি নেওয়া হলে বিলে উল্লিখিত ক্ষতিপূরণের সংস্থান কার্যকর হবে না। ‘কৃষক স্বার্থে’ই ওই প্রস্তাবিত বিল নতুন করে খসড়া করা এবং তার জন্য কৃষক ও আদিবাসীদের ‘গণতান্ত্রিক সংগঠন’গুলির সুপারিশ খতিয়ে দেখার দাবি তোলা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটের আগে ‘কৃষক স্বার্থে’র কথা ভাবতে গিয়ে তাঁরা যে অবস্থান নিলেন, তা কি তৃণমূল নেত্রীর কাছাকাছিই তাঁদের এনে ফেলছে না? পলিটব্যুরোর সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার সাংসদ ইয়েচুরি এ দিন পার্টি কংগ্রেসের বিতর্কের ফাঁকে আনন্দবাজারকে বলেছেন, “বিষয়টা তেমন নয়। তৃণমূল নেত্রী জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকার বিরোধী। আমরা কিন্তু অধিগ্রহণে সরকারি হস্তক্ষেপের পক্ষে। আমরা বরং জোর দিচ্ছি পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে। তফাত এখানেই।”
ইয়েচুরির ব্যাখ্যা, “জমির মালিকানা যাঁদের হাতে, আমরা তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে এগোনোর কথা বলছি। কিছু ক্ষেত্রে (প্রস্তাবে যেমন বলা হয়েছে) ক্ষতিপূরণের শর্ত কার্যকর হবে না, এরই বা যুক্তি কী? এমনিতেই কেন্দ্রের প্রস্তাবিত বিলে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পর্যাপ্ত নয়। যেখানে জমি নিতে হবে, সেখানে সম্ভাব্য ‘স্টেকহোল্ডার’দের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। নতুন প্রকল্পে জমিহারাদের সামিল করতে হবে। এটাই আমাদের বক্তব্য।”
গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ রাজ্যই ভূমি সংস্কারের কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে না। গরিব, ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বিলি হচ্ছে না। ভূমি সংস্কারের এই কাজ এখন দেশের একমাত্র বামশাসিত রাজ্য ত্রিপুরার সরকার করছে, যা আগে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলের বাম সরকারই শুধু করেছে। প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য হল, ‘ল্যান্ড মনোপলি’ বা অল্প কিছু লোকের হাতে জমি কুক্ষিগত হয়ে থাকার বিষয়টি ভাঙতে পারলে তবেই গরিবের ‘মুক্তি’র পথে এগোনো সম্ভব। প্রতিবন্ধীদের অধিকার এবং রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর করার দাবিতে আরও দু’টি প্রস্তাব পাশ হয়েছে পার্টি কংগ্রেসের চতুর্থ দিনে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ভূমি সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাবে কিছু রাজ্যে জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদের প্রতিবাদ করা হয়েছে। প্রস্তাবে নাম না-করলেও গত ১০ মাসে পশ্চিমবঙ্গে মমতার সরকারের বিরুদ্ধে বারবার এই অভিযোগ তুলেছেন সূর্যবাবুরা। আবার প্রস্তাবে এ-ও বলা হয়েছে, কর্পোরেটদের হাতে জমি তুলে দিতে সচেষ্ট বেশ কিছু রাজ্য এবং কেন্দ্রের সরকার। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় যে অভিযোগে বহু বার সরব হয়েছেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা!
অর্থাৎ মমতার প্রতি দোষারোপ অব্যাহত থাকলেও সিপিএম আপাতত ঘুরেফিরে সেই মমতারই ‘পথে’! |