ভুল সকলের। কিন্তু ‘দায়’ কার? বিপর্যয়ের সিপিএমে ফের বিতর্ক তুঙ্গে!
নির্বাচনী বিপর্যয়-সহ সাম্প্রতিক কালে দলের নানা ভুল সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের ‘দায়’ যৌথ ভাবে সকলকেই নিতে হবে বলে শুক্রবার পার্টি কংগ্রেসে রাজনৈতিক দলিল ও পর্যালোচনা রিপোর্টের উপরে বিতর্কের জবাবি ভাষণে জানিয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। তার ২৪ ঘণ্টা পর পলিটব্যুরোয় কারাটেরই সতীর্থ সীতারাম ইয়েচুরির ‘ভিন্ন সুর’ বিতর্ক বাড়াল! ইয়েচুরি আজ বলেন, “যৌথ ভাবে কাজ করা যায়, সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। কিন্তু তা-ই বলে ব্যক্তিগত দায় থাকবে না, তা হয় না! লেনিনের কথাতেই দু’টো জিনিস আছে‘কালেকটিভ ফাংশনিং’ এবং ‘ইন্ডিভিজ্যুয়াল রেসপনসিবিলিটিজ’!” (যদিও দলের একাংশের বক্তব্য, লেনিনের ব্যবহৃত শব্দবন্ধটি ‘কালেকটিভ ডিসিশন’, ‘ফাংশনিং’ নয়)।
সিপিএমের সংখ্যাগরিষ্ঠের মত, ইয়েচুরির এই মন্তব্যের লক্ষ্য আসলে কারাট। কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গ-সহ জাতীয় ক্ষেত্রে লাগাতার বিপর্যয়ের জন্য সাধারণ সম্পাদক তাঁর ‘দায়’ এড়াতে পারেন না, এই সহজ কথাটাই কমিউনিস্ট-সুলভ শব্দ-চাতুরির আশ্রয়ে বোঝাতে চেয়েছেন সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বের ‘নাম্বার টু’। আবার একাংশের মতে, ইয়েচুরি যে যুক্তিতে ক্ষেপণাস্ত্রটি ছুড়েছেন, তাতে কারাট থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যে কেউই নিশানায় পড়তে পারেন! দলের বিপর্যয়ের জন্য কারাট যদি ‘দায়’ এড়াতে না-পারেন, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে ভরাডুবির জন্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুও পারেন না! একই যুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গে দলের রাজ্য সম্পাদক হিসেবে বিমান বসুও ‘মুক্তি’ পান না!
তেলুগু ব্রাহ্মণ, দুঁদে বক্তা ইয়েচুরি মন্তব্য করেছেন অত্যন্ত সুকৌশলে। নিজের ‘দায়’ অস্বীকার করেননি। কিন্তু তার মধ্যেও ‘ব্যক্তিগত দায়ে’র কথা আলাদা করে টের পাইয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথার নির্যাস হল, ম্যাচ হারলে ব্যাটসম্যান-বোলার সকলের তাতে ভূমিকা এবং দায়িত্ব থাকবে ঠিকই। কিন্তু ক্যাপ্টেন তা বলে পালাতে পারবে না!
পার্টি কংগ্রেসের বিরতিতে ইয়েচুরির কাছে প্রশ্ন ছিল: এত আলোচনা হচ্ছে, দলের নানা নীতি ও সিদ্ধান্তের এত পর্যালোচনা হচ্ছে। সাধারণ সম্পাদকের ‘পারফরম্যান্স’ পর্যালোচনা হবে না? ইয়েচুরির জবাব, “যৌথ ভাবেই ঠিক হবে, বাঁচবেন না ডুববেন! বাঁচলে সবাই একসঙ্গে দাঁড়াব! ডুবলে সবশুদ্ধ ডুবব! তবে শুধু যৌথ দায়িত্ব ব্যাপারটা ঠিক নয়। যৌথ ভাবে কাজ হয়। কিন্তু ব্যক্তির দায়িত্বও থাকে।” দল সাম্প্রতিক কালে যা যা ভুল করেছে, তার জন্য দায় কার? ইয়েচুরির মতে, “যা যা ঘটেছে, পলিটব্যুরোর সদস্য হিসেবে আমি তার দায় এড়াতে পারি না। চাই বা না-চাই, এই দায় থেকে আমি পালাতে পারি না। কিন্তু শেষে ব্যক্তিগত দায়িত্বও একটা থাকে!”
সিপিএমের শীর্ষ মহলে কারাট-ইয়েচুরি ‘সমীকরণে’র পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্য আলোড়ন ফেলে দেওয়ার মতো! যদিও দলের একটা বড় অংশের বক্তব্য, ভুলের দায়ের বিষয়টি রাজনৈতিক পর্যালোচনার জবাবি বক্তৃতাতেই মীমাংসা করে দিয়েছেন কারাট। চলতি পার্টি কংগ্রেসে আর এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। পার্টি কংগ্রেসের বাইরে চর্চা চলতে পারে। ইয়েচুরির ব্যাখ্যা, “ভুল-ভ্রান্তি তো হয়েছেই। ভুল করা ব্যাপারটা খুব বড় ভুল নয়। কিন্তু ভুলগুলো চিনতে না-শেখা, বারবার সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করা, সেই ভুল আর যাতে না-হয়, সেটা নিশ্চিত না-করতে পারা এগুলো হচ্ছে বড় ভুল। এর কিছু অংশ হয়তো সাংগঠনিক রিপোর্ট নিয়ে আলোচনায় আসতে পারে।”
বস্তুত, ইয়েচুরির এই মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পরেই এ দিন সন্ধ্যার অধিবেশনে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেছেন কারাট-ঘনিষ্ঠ পলিটব্যুরোর সদস্য এস আর পিল্লাই। দলীয় সূত্রে খবর, রিপোর্টের মূলত চারটি ভাগ। রিপোর্ট পেশ করতে গিয়ে রুদ্ধদ্বার আলোচনায় পিল্লাই বলেন, সামগ্রিক ভাবে গত কয়েক বছরে সিপিএম তেমন দাগ কাটতে পারেনি। গোটা দেশের দলের সদস্য সংখ্যার ৭৩%-ই এসেছে পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও ত্রিপুরা থেকে। এর সঙ্গে তামিলনাড়ুকে ধরলে ওই হার ৯০% হয়ে যায়। সুতরাং, দলের বিস্তার ‘সুষম’ হচ্ছে না। সংগ্রাম গড়ে তোলার বদলে শুধু প্রচার চালিয়েই দল ক্ষান্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন দেখার, কাল, রবিবার ওই রিপোর্ট নিয়ে আলোচনায় সাংগঠনিক ব্যর্থতার জন্য সাধারণ সম্পাদকের ‘ব্যক্তিগত দায়িত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কি না।
ঘটনাচক্রে, এ দিনই সন্ধ্যায় পার্টি কংগ্রেসে পেশ হয়েছে দলীয় গঠনতন্ত্রের সংশোধনী প্রস্তাব। যা পাশ হলে সর্ব স্তরের কমিটির সম্পাদকদের পদের মেয়াদ তিন বারে (বিশেষ ক্ষেত্রে চার বার) বেঁধে দেওয়া হবে। প্রস্তাব এখনও পাশ হয়নি বলে পার্টি কংগ্রেসের আগে রাজ্য সম্মেলনগুলিতে রাজ্য সম্পাদক পদে বিশেষ বদল হয়নি। তিন বারের মেয়াদ পেরিয়ে গিয়ে থাকলেও। এ বার ওই প্রস্তাব পাশ হলে (যা এক রকম অবধারিত) তার বলে আরও এক দফা কারাটের সাধারণ সম্পাদক থেকে যাওয়া আটকায় না। তা ছাড়া, কেন্দ্রীয় কমিটিতে এবং সর্বভারতীয় স্তরে কারাট-শিবিরই এখনও দলে ভারী। যে জন্য ‘ব্যক্তি’ কারাট উদ্বেগে নেই! তিনি জানেন, সংখ্যা তাঁর পক্ষে! এই পার্টি কংগ্রেসের ফাঁকেই কারাট বলে রেখেছেন, সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইস্তফার কথা কখনও তাঁর মনে হয়নি। তা ছাড়া, কমিউনিস্ট পার্টিতে ওই ভাবে ভাবনাচিন্তা হয় না।
পশ্চিমবঙ্গ বা অন্যত্রের প্রতিনিধিরা কি তাঁর নেতৃত্বের দিকে আঙুল তুলছেন? তাঁকে সরে দাঁড়াতে বলছেন? কারাটের সহাস্য জবাব ছিল, “এখনও শুনিনি! তবে আলোচনা করে কী আর হবে? যখন সম্পাদক নির্বাচন হবে, তখন সরিয়ে দিলেই হল!” কারাট জানতেন, তাঁকে সরানোর সংখ্যা জোগাড় কার দুরূহ! ইয়েচুরিও তা জানেন। তবু ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটা বিষাক্ত ডেলিভারি ‘ক্যাপ্টেনের’ দিকে ছেড়ে রাখলেন! |