চিনে সমাজতন্ত্র আছে না নেই, পার্টি কংগ্রেসের আগে মতাদর্শগত বিষয়ে এটাই ছিল সবথেকে বড় প্রশ্ন। পার্টি কংগ্রেসে এসে আরও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল, উত্তর কোরিয়াকে এখনও সমাজতান্ত্রিক দেশ বলা উচিত কি না।
পার্টি কংগ্রেসের আগে সিপিএমের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল ‘চিনের প্রাচীর’। চিন বড় পুঁজিপতিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শিল্পায়নের যে পথে হাঁটছে, এ দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে অনুসরণ করা যায় কি না, সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন। যার প্রেক্ষাপট ছিল পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের ব্যর্থতা। চিনের মডেলকেই উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-নিরুপম সেনরা। মতাদর্শগত দলিলে এ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। কট্টরপন্থীরা চিনের মডেল বাতিলের দাবি তোলেন। পার্টি কংগ্রেসে এসে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের মুখপত্রে কর্মরত তাত্ত্বিক নেতা দেবাশিস চক্রবর্তী চিনের সাফল্য তুলে ধরে জোর সওয়াল করেছেন। আবার পাল্টা যুক্তিও উঠেছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, সমাজতন্ত্রের পক্ষে চিনের অভিমুখ গুলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং চিনের উপর চাপের কথাও মনে রাখতে হবে।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্য মনে করছে, সাধারণ ভাবে একটা ঐকমত্যের ছবি তৈরি হয়েছে। অধিকাংশ নেতারই বক্তব্য, চিন থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে, এ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু চিনের ত্রুটিগুলিরও সমালোচনা করা প্রয়োজন। অন্যথায় চিনা কমিউনিস্ট পার্টি ও সিপিএমের অবস্থান যে পৃথক, তা স্পষ্ট হবে না। সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “চিন দারুণ উন্নতি করেছে। আমেরিকার পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। কিন্তু এমন কিছু সমস্যাও উঠে এসেছে, সমাজতান্ত্রিক দেশে যা হওয়া উচিত ছিল না।”
গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে উত্তর কোরিয়া নিয়েও। মতাদর্শগত দলিলে সমাজতান্ত্রিক দেশের তালিকাতেই উত্তর কোরিয়া স্থান পেয়েছিল। কিন্তু সম্মেলনে অধিকাংশ নেতানেত্রীই প্রশ্ন তুলেছেন, কিম জং ইলের মৃত্যুর পর যে ভাবে তাঁর পুত্র কিম জং উনকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করা হয়েছে, তা কোন লেনিনবাদী সাংগঠনিক তত্ত্বে রয়েছে? দীর্ঘদিন উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টিতে কোনও পার্টি কংগ্রেস হয়নি। কিমের ইচ্ছাতেই তাঁর মৃত্যুর পর পুত্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোনও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ধার দিয়েও হাঁটা হয়নি। মতাদর্শগত দলিল পেশ করার সময় ইয়েচুরিও উত্তর কোরিয়াকে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘উত্তরাধিকার সূত্রে নেতা বাছাইটাই ওরা বিজ্ঞানসম্মত বলে ধরে নিয়েছে!’ যাতে হাসির রোল উঠেছে পার্টি কংগ্রেসের প্রেক্ষাগৃহে।
তাতে বিতর্ক থামেনি। কিম জং ইলের মৃত্যুর পর দিল্লিতে সিপিএম শোকসভা করেছিল। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির তরফে দীর্ঘ শোকবার্তাও পাঠানো হয়। সেখানে উত্তর কোরিয়াকে ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পার্টি কংগ্রেসের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কিষাণ সভার বিজু কৃষ্ণন, দিল্লি রাজ্য কমিটির সদস্য আলবিনা শাকিল, কেন্দ্রীয় ইউনিটের অমিত সেনগুপ্তর মতো নবীন প্রজন্মের নেতানেত্রীরা এ নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন।
চিন নিয়ে বিতর্কে দেবাশিস চক্রবর্তীর বক্তব্য, তাদের সাফল্য অভূতপূর্ব হলেও কিছু সমস্যা আছে। তবে মনে রাখতে হবে, দারিদ্র দূরীকরণে চিন সবথেকে এগিয়ে। ব্রিকস হোক বা রাষ্ট্রপুঞ্জ, ইরানের প্রশ্ন হোক বা সিরিয়ার, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে চিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। ওড়িশার নেতা সন্তোষ দাসের যুক্তি, চিনের সংস্কারের পথ সঠিক। অন্য দিকে কর্নাটকের বি মাধব চিনের সমাজতান্ত্রিক মডেলের নেতিবাচক দিকগুলি নিয়ে সরব হয়েছেন। দলের কট্টরপন্থীদের মতে, চিনের পার্টি শ্রমিক-কৃষকদের পাশাপাশি পুঁজিপতিদেরও পার্টি হয়ে উঠেছে। নাগরিক অধিকার নেই। শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের যুক্তি, ‘সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র শ্রমিক শ্রেণির চরিত্র থেকে আলাদা করা যাবে না।’ দিল্লির আলবিনার মতে, সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকবে, গণতন্ত্রও থাকবে। ‘সবর্হারার একনায়কতন্ত্র’ বাদ দিলেও তার যে বৈপ্লবিক সারবস্তু, তা বাদ দিলে চলবে না। আলবিনার পরামর্শ, চিনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও যে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ চলছে, তা আরও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ চিনের পার্টির একটা অংশ দলীয় নীতির বিরুদ্ধে মত দিচ্ছে। অসমে দলীয় মুখপত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপ্রকাশ তালুকদারের বক্তব্য, বাইরের শক্তির মদতে এ দেশে চিন-বিরোধী যে প্রচার চলছে, তা রুখতে হবে। কিন্তু অরুণাচলের উপর অধিকার নিয়ে চিনের দাবিরও বিরোধিতা করতে হবে।
চিনের ক্ষেত্রে খসড়া দলিলে চূড়ান্ত কোনও ফয়সালা হয়নি। মতাদর্শগত দলিলে উত্তর কোরিয়ার মাথা থেকে সমাজতান্ত্রিক দেশের মুকুট খুলে নেওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছেন দলের একটা বড় অংশ। কাল এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা হবে।
প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যখন ভারতীয় পথেই চলার কথা বলছে, তখন বিদেশের কমিউনিস্ট পার্টির চরিত্র, গুণাগুণ নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছে কেন? দলের এক ‘বাস্তববাদী’ নেতার প্রশ্ন, “কোনও দিন শুনেছেন, সিপিএম সমাজতন্ত্রের পথে চলছে কি না তা নিয়ে চিনে বা উত্তর কোরিয়ায় বিতর্ক হচ্ছে? সিপিএম ওদের সমাজতান্ত্রিক বলল কি না, তাতেই বা চিন-উত্তর কোরিয়ার কী এসে যায়?” যার জবাবে ইয়েচুরির ব্যাখ্যা, “কোনটা সঠিক পথ, কোনটা বেঠিক, সেই অবস্থান নেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। আমরা শুধু চিন, রাশিয়া, কিউবা বা লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করছি। যাতে আমরা নিজেদের মতো করে ভারতীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি।”
আজ সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রভাত পট্টনায়কও। বিতর্কে অংশ নিয়ে প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ মনে করিয়ে দিয়েছেন, পুঁজির চরিত্র আন্তর্জাতিক। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন এক এক দেশে এক এক রকম। ইয়েচুরি সেই সুর ধরেই বলেছেন, “ভারতীয় বাস্তবতা মেনে কী ভাবে রাজনৈতিক বিকল্প গড়ে তোলা যায়, আমাদের সেটাই দেখতে হবে’’ |