ম্যারাথনে বিস্ফোরণের ঠিক আগে তোলা একটি ভিডিও ফুটেজ থেকে এক সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করেছেন তদন্তকারীরা। একটি সূত্রের খবর, সম্ভবত ওই ব্যক্তিই সোমবার বস্টন ম্যারাথনের ফিনিশিং লাইনের কাছে বোমা রেখেছিল বলে গোয়েন্দারা অনুমান করছেন।
বিস্ফোরণের রহস্যভেদ করতে সে দিন ঘটনাস্থলের আশপাশে মোতায়েন কয়েকশো ক্যামেরার উপর গোড়া থেকেই ভরসা করেছিল এফবিআই। এর মধ্যে দর্শক-সমর্থকদের স্মার্টফোন-ক্যামেরা যেমন ছিল, তেমনই ছিল রাস্তায় আশপাশের অফিসগুলোর সিসিটিভি এবং বিভিন্ন চ্যানেলের ফুটেজ। গোয়েন্দাদের তরফে সর্বস্তরে আবেদন রাখা হয়েছিল, ম্যারাথনের ছবি যেন তাঁদের দেওয়া হয়। এমনকী বস্টন ছাড়ার সময়ে বিমানবন্দরে অ্যাথলিটদেরও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল সে কথা। এর পরেই গোয়েন্দা-অফিসে এসেছে অজস্র স্টিল ও ভিডিও ফুটেজ। সেগুলি খতিয়ে দেখেই ওই সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে সূত্রটি জানিয়েছেন।
ফলে কিছুটা আশা দেখছেন তদন্তকারীরা। ইতিমধ্যে এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে শোনা গিয়েছিল। সেই দাবি উড়িয়ে দিয়েছে এফবিআই। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ম্যারাথনের বিস্ফোরণকে জঙ্গি হামলা ধরে নিয়েই এফবিআই তদন্ত করছে। এ দিকে, ওবামাকেই পাঠানো একটি চিঠিতে ‘রাইসিন’ বিষ পাওয়া গিয়েছে। এই ঘটনায় মাথাব্যথা বেড়েছে গোয়েন্দাদের। |
বস্টন ম্যারাথনে বিস্ফোরণের দায় অবশ্য এখনও স্বীকার করেনি কেউ। তবে কী ভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল, সেটা এখন মোটামুটি গোয়েন্দাদের কাছে পরিষ্কার। আজ কয়েকটা ছবিও প্রকাশ করেছে এফবিআই। তাতে দেখা যাচ্ছে একটা তোবড়ানো ধাতব ঢাকার মতো অংশ, ছিঁড়ে ফালাফালা হওয়া একটা কালো ব্যাগ, নাইলনের কিছু টুকরো। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ধাতব টুকরোটা একটা প্রেসার কুকারের। প্রথম বোমাটা একেবারেই ঘরোয়া জিনিসপত্র দিয়ে তৈরি প্রেসার কুকার বোমা। সেখানে প্রেসার কুকারের মধ্যে ঠাসা ছিল পেরেক আর বল বেয়ারিং। আর ছিল কালো কোনও পাউডার। ডিম সেদ্ধ করার এক ধরনের কাউন্টডাউন টাইমার দেওয়া যন্ত্র ব্যবহার হয় বিদেশের হেঁশেলে। এই বোমার টাইমার এবং ট্রিগার সম্ভবত সেই রকম কোনও যন্ত্র।
গোয়েন্দারা আঁচ করছেন, প্রেসার কুকার বোমাটা সম্ভবত ওই ব্যাগে ভরে রাস্তার ধারে রাখা ছিল। কুকার বা ব্যাগটা কোন ব্র্যান্ডের, তা বোঝার অবশ্য উপায় নেই। তবে কুকারের ওই অংশটায় (সম্ভবত ঢাকনা) খোদাই করা রয়েছে ‘৬ এল’। অর্থাৎ ৬ লিটারের প্রেসার কুকার। গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছেন, কোন কোন কোম্পানির প্রেসার কুকারের গায়ে এ ভাবে ধারণক্ষমতা খোদাই করা থাকে। অন্তত ব্র্যান্ডটা জানা গেলে কবে, কোন স্টোর থেকে কে ওই প্রেসার কুকার কিনেছে, সেটা বার করা গেলেও যেতে পারে বলে আশা করছেন তাঁরা। দ্বিতীয় বোমাটিও ছিল ধাতব পাত্রে। সেটাও প্রেসার কুকার কি না, সেটা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
আসলে তদন্তকারীদের বড় সমস্যা হয়েছে কোনও জঙ্গি সংগঠনের দায় না নেওয়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও অপেশাদার বা দু-তিন জনের ছোট সংগঠন নাশকতা ঘটালে প্রাথমিক ভাবে তদন্তের জাল বিছোতে অসুবিধে হয়। এই বিস্ফোরণের চক্রান্ত সে রকমই কোনও ‘একক’ কীর্তি কি না, সেটাই বোঝার চেষ্টা চলছে। তবে এর পাশাপাশিই সন্দেহের তালিকায় রয়েছে আল-কায়দার ইয়েমেনের শাখাটিও। ২০১০-এ তাদের অনলাইন পত্রিকার একটি সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনিই ছিল প্রেসার কুকার বোমা নিয়ে। তার শিরোনাম ছিল ‘রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে বোমা বানাও।’ আমেরিকায় এই বোমার ব্যবহার খুব একটা যে দেখা গিয়েছে, এমন নয়। বরং সেটা বেশি হয়েছে ভারত, নেপাল, আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে। মুম্বইয়ের লোকাল ট্রেনে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ তো পুরোটাই হয়েছিল প্রেসার কুকার বোমা দিয়ে। তবে ২০১০-এ নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে গাড়িবোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা হয়েছিল প্রেসার কুকার ব্যবহার করে।
ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা সমস্ত তথ্যপ্রমাণ ভার্জিনিয়ার কোয়ান্টিকোয় এফবিআইয়ের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। বস্টনের বয়েলস্টন স্ট্রিটের বিস্ফোরণস্থল ঘিরে বসেছে পুলিশ ব্যারিকেড। সেই ব্যারিকেডের সামনেই জমছে ফুল, মোমবাতি আর শোকবার্তা। ইতিমধ্যে বিস্ফোরণের নিন্দা করেছেন ইরানের নেতা খামেনেই। নিহতদের মধ্যে ৮ বছরের মার্টিন রিচার্ড ছাড়া আরও দু’জনের পরিচয় জানা গিয়েছে আজ। তাঁদের এক জন, ২৯ বছরের তরুণী ক্রিস্টেল ক্যাম্পবেল, বাড়ি ম্যাসাচুসেটসের আর্লিংটনে। অন্য জন বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিনা ছাত্রী। পরিবারের অনুমতি না আসা পর্যন্ত তাঁর পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
আজ দিনভর কেমন খাঁ খাঁ করেছে বস্টন। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় পুলিশি প্রহরা। বিদেশ থেকে ম্যারাথনে পা মেলাতে আসা মানুষগুলো এ সবে বিচলিত হননি। তাঁদের অনেকেই শহর ছাড়ার আগে বলে গিয়েছেন, ২০১৪-এর ম্যারাথনে আবার আসবেন বস্টনে। দৌড়েই হারিয়ে দেবেন সন্ত্রাসকে!
|
বস্টন ম্যারাথনের জোড়া বিস্ফোরণ থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক মার্কিন ডাক্তার, বিবেক শাহ। ঘটনার সময় ফিনিশ লাইন থেকে মাত্র ২৫ গজ দূরে ছিলেন তিনি ও তাঁর পরিবার সকলে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তাঁদের কারও কিছু হয়নি।
|