ঘড়িতে তখন দুপুর তিনটে বাজতে দশ মিনিট বাকি। বস্টন ম্যারাথনের আসর জমজমাট।
৭৪টি দেশ থেকে আসা ২৩ হাজার প্রতিযোগীর অর্ধেকের বেশিই তত ক্ষণে ছুঁয়ে ফেলেছেন ফিনিশিং লাইন। পিছিয়ে পড়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা তখনও ছুটছেন। হঠাৎ কান ফাটানো আওয়াজ। দৌড়তে থাকা পা-গুলো শরীর থেকে ছিঁড়ে পাক খেতে খেতে লাফিয়ে উঠল আকাশে।
কোথা থেকে কী হল? বিভ্রান্ত চোখগুলো যখন ইতিউতি খুঁজছে, ১৩ সেকেন্ডের মধ্যে কয়েকশো ফুট দূর থেকে আবার বিকট শব্দ। রাস্তার দু’পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে বহু লোক। তাঁদের মধ্যে কারও বাবা-ভাই-বোন-বন্ধু রয়েছেন দৌড়ে। কেউ বা জড়ো হয়েছিলেন শুধুই খেলার টানে। তাঁদের মাথার উপরেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল আশপাশের বাড়ির কাচ।
ম্যারাথনের ট্র্যাক নিমেষে রক্তে পিচ্ছিল। তিনটি প্রাণ চলে গিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বাবার জন্য হাসিমুখে অপেক্ষা করে থাকা খুদে রিচার্ডও। আহত কম করে ১৭৬ জন। রিচার্ডের মা আর বোন রয়েছে সেই তালিকায়।
গত এক দশকে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ার আর সাবওয়েতে দু’বার জঙ্গি নাশকতা ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল। সফল হয়নি। সে দিক থেকে ৯/১১-র পর এই প্রথম আবার জঙ্গি সন্ত্রাসের সামনে পড়ল আমেরিকা। যদিও এখনও পর্যন্ত কোনও জঙ্গি সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। ঘটনার পরপরই প্রথম যে বিবৃতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, তাতে একে সরাসরি জঙ্গি হামলা বলেননি তিনি। পরে অবশ্য ওবামা এই ঘটনাকে ‘কাপুরুষোচিত সন্ত্রাস’ বলে বর্ণনা করেন। |
বয়েলস্টন স্ট্রিটে বিস্ফোরণের মুহূর্ত। ছবি: রয়টার্স |
মার্কিন গোয়েন্দা প্রশাসন একটা কথা স্বীকার করছে। সেটা হল, যত যাই হোক, ৯/১১-র পর এতগুলো বছর মোটামুটি নিরুপদ্রবে থেকে মার্কিন জনতার মনে একটা নিশ্চিন্তির বোধ তৈরি হয়েই গিয়েছিল। নাশকতার মুখোমুখি হলে কেমন লাগে, সেটা খানিক ভুলতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। আজকের ঘটনা জনজীবনের মেরুদণ্ডে ফের ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিল।
কারা ঘটাল এই নাশকতা? এখনও অবধি তার কোনও স্পষ্ট দিকনির্দেশ পাননি গোয়েন্দারা। বিদেশি হাত রয়েছে কিনা, তাও জানা যায়নি। পাক তালিবান গোষ্ঠী জানিয়ে দিয়েছে, তারা এর পিছনে নেই। তা ছাড়া, আল কায়দা বা তেমন বড় কোনও আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী হলে নিউ ইয়র্ক বা ওয়াশিংটন ছেড়ে বস্টনে হামলা চালাত কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। স্থানীয় স্তরে গড়ে ওঠা কোনও জেহাদি সংগঠন সক্রিয় হল কি? সেটাই খোঁজার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
ঠিক কতগুলো বিস্ফোরণ হয়েছিল, প্রথমে তা নিয়েও বিভ্রান্তি ছিল। না-ফাটা আরও দুটো বোমা উদ্ধার হয়েছে বলে গোড়ায় জানানো হয়েছিল। পরে সাংবাদিক বৈঠক করে এফবিআইয়ের গোয়েন্দারা বলেন, ওই তথ্য ঠিক নয়। পাশের একটি লাইব্রেরিতে তৃতীয় বিস্ফোরণ হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গিয়েছিল। পরে জানা যায়, লাইব্রেরির আগুনের সঙ্গে বিস্ফোরণের কোনও যোগ নেই।
তবে এটা জানা গিয়েছে, ব্যবহৃত বোমাগুলি এক রকম কালো গুঁড়োর বিস্ফোরক ও বল বিয়ারিং দিয়ে তৈরি। খুব পেশাদারি হাতের ছাপ নেই। ম্যারাথনের রাস্তায় ভিড় হবে বলে সেখানে গাড়ি রাখতে দেয় না
পুলিশ। তাই গাড়িতে বিস্ফোরক রেখে হামলা চালানোর উপায় ছিল না।গোয়েন্দাদের মতে, বড় বিস্ফোরণের উপায় না থাকায় বাড়িতে বানানো বোমা দিয়েই কাজ সেরেছে হামলাকারীরা। পুলিশ সূত্রের খবর, হুডওয়ালা কালো সোয়েড শার্ট পরা এক অশ্বেতাঙ্গ যুবককে জেরা করা হচ্ছে। সে নিজে বিস্ফোরণে আহত। প্রথম বিস্ফোরণটি হয় একটি জঞ্জালের পাত্রের মধ্যে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে ওই যুবককে অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখা গিয়েছিল। জানা গিয়েছে, সৌদি আরব থেকে আসা যুবকটি পড়াশোনা করতে আমেরিকায় এসেছেন। সোমবার রাতে তাঁকে দীর্ঘ ক্ষণ জেরা করেন গোয়েন্দারা। বিস্ফোরণস্থলের কাছে তার আস্তানা, একটি বহুতলেও হানা দেন তাঁরা। |
রক্তাক্ত ফুটপাথে জখম মহিলা অ্যাথলিটের শুশ্রূষা। ছবি: এপি |
বস্টন ম্যারাথনের আসর বসে কপলে স্কোয়্যারের উল্টো দিকে ওই বয়েলস্টন স্ট্রিটেই। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম যুদ্ধের স্মরণে এপ্রিল মাসের তৃতীয় সোমবারটি আমেরিকায় ‘পেট্রিয়টস্ ডে’ বলে পরিচিত। ১৮৯৭ সাল থেকে এই দিনটাতেই হয়ে আসছে ২৬ মাইল পাল্লার বস্টন ম্যারাথন। প্রতিযোগীদের শুশ্রূষার জন্য ডাক্তারদের ছাউনি ছিলই। বিস্ফোরণের পর সেগুলোই হয়ে উঠল প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র।
যাঁরা অক্ষত রয়েছেন, তাঁদেরও তাড়া করছে আতঙ্ক। ছাব্বিশ বছরের জারেট সেলভেস্টার খোশমেজাজে দৌড়চ্ছিলেন। প্রথম বিস্ফোরণের আওয়াজটা কানে যেতে ভেবেছিলেন, উৎসাহের চোটে কেউ বুঝি কামান ফাটাচ্ছেন। “কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে দেখি তালগোল পাকানো ধ্বংসস্তূপের টুকরো উড়ছে আকাশে। সঙ্গে সঙ্গে উল্টো দিকে দৌড়তে শুরু করলাম।”
দু’দুবার বিস্ফোরণের মুখে পড়েও ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচেছেন ভার্জিনিয়ার স্টেফানি ডগলাস। ২০০৮-এ মুম্বই বিস্ফোরণের সময় ভারতে এসেছিলেন তিনি। আর এ বার বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলেন বস্টন ম্যারাথনের সাক্ষী থাকতে। তবে নিজের বিশ্বাস এখনও হারাননি স্টেফানি। জঙ্গিরা যতই নিশানা করুক না কেন, খেলোয়াড়ি মনোভাব দিয়েই হারাতে হবে তাকে বলছেন তিনি।
তবে মার্কিন প্রশাসন অবশ্যই শুধু মনের জোরের উপরে ভরসা করে বসে নেই। হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন, ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টার, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ে জোরদার হয়েছে নিরাপত্তা। ওবামাকে চিঠি লিখে এই নাশকতার নিন্দা করেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। আসন্ন লন্ডন ম্যারাথন পূর্বসূচি অনুযায়ীই হবে বলে জানা গিয়েছে। তবে মাদ্রিদ ম্যারাথনের সূচি বদলাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।
|