দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই ছিমছাম দোতলা বাড়িটার সিঁড়ির ধাপে কারা যেন রেখে গিয়েছে ফুলের তোড়া। পাথুরে রাস্তা গিয়ে উঠেছে ওই সিঁড়িতে। রাস্তাটার ওপর চকখড়ি দিয়ে লেখা ‘পিস’ (PEACE)। গত রাতেই ফিরেছেন ওই বাড়ির বাসিন্দা বিল রিচার্ড। প্রতিবেশীরা বলছিলেন, দীর্ঘ, ছিপছিপে চেহারার বিলকে হেঁটে আসতে দেখে তাঁদের মনে হচ্ছিল, যেন একটা জীবন্ত লাশ হেঁটে আসছে। পরনে হাসপাতালের রোগীদের পোশাক। যান্ত্রিক পদক্ষেপ, শূন্য দৃষ্টি।
বস্টন ম্যারাথনে দৌড়তে গিয়েছিলেন বিল। ছুটির মেজাজে, স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নিয়ে। ডরচেস্টারের বাড়িতে যখন ফিরলেন, তখন তাঁর পরিবারটাই কার্যত শেষ হয়ে গিয়েছে।
দৌড় শেষ করলেই বাবাকে জড়িয়ে ধরবে বলে ফিনিশিং লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল বিলের ছোট ছেলে, ৮ বছরের রিচার্ড। তার জীবন শেষ করে দিল সোমবার দুপুরের বিস্ফোরণ। রিচার্ডের দু’বছরের ছোট বোন জেনের একটা পা উড়ে গিয়েছে। তাদের মা ডেন্সি মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। একমাত্র বিলের বড় ছেলে হেনরির কিছু হয়নি।
শুধু নিহতের সংখ্যা দিয়ে বস্টন বিস্ফোরণের ভয়াবহতাকে মাপতে যাওয়া তাই ভয়ঙ্কর ভুল হবে। ঠিক কত জনের পা উড়ে গিয়েছে, বা অস্ত্রোপচার করে হাত-পা বাদ দিতে হয়েছে, তার কোনও সঠিক হিসেব এখনও নেই। সব চেয়ে মর্মান্তিক হল, যে মানুষগুলো ২৬ মাইলেরও বেশি লম্বা ম্যারাথনে দৌড়লেন, দৌড় শেষ করার পর তাঁদের অনেকেরই এখন পা নেই! |
|
|
মার্টিন রিচার্ড |
মার্টিনের বোন জেন |
|
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বিস্ফোরণ যখন হয়, ঠিক তখনই প্রতিযোগীদের একটা বেশ বড় ঝাঁক এগিয়ে আসছিল ফিনিশিং লাইনের দিকে। গত বছরের বস্টন ম্যারাথনের হিসেব বলছে, বেলা ৩টের আশপাশে মোটামুটি ৮-৯ হাজার প্রতিযোগী দৌড় শেষ করেছিলেন। কাজেই বিস্ফোরণের সময়ে ফিনিশিং লাইনের কাছে কত জন প্রতিযোগী ছিলেন, তার একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। ওই ঝাঁকের মধ্যেই ছিলেন সাতাশের তরুণী দিয়াদ্রে হ্যাটফিল্ড। দৌড় শেষ করার কয়েক পা আগে বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন। পরমুহূর্তেই দেখেন, আশপাশে ছিটকে এসে পড়ল কয়েকটা রক্তাক্ত শরীর।
চারদিকে চোখ বুলিয়ে পোড় খাওয়া দমকল অফিসাররা পর্যন্ত কেঁপে যাচ্ছেন। বস্টন দমকলের শীর্ষ কর্তা রন হ্যারিংটন বলছিলেন, “২৮ বছরের চাকরিতে এমন ভয়াবহতা দেখিনি। চার দিকে রক্ত আর দেহাংশ। একটা বাচ্চা ছেলে আর এক তরুণীর মৃতদেহ পড়ে। দু’টো লোকের হাত আলগা হয়ে ঝুলছে। এক জনের পা নেই। একটা জুতো পড়ে, তাতে মাংস লেগে।” শহরের হাসপাতালগুলোর অবস্থা যুদ্ধক্ষেত্রের সেনা হাসপাতালের মতো। আনা হচ্ছে একের পর এক আহতকে, প্রায় একই ধরনের ক্ষত, অস্ত্রোপচারও প্রায় একই ধাঁচের অনেক ক্ষেত্রেই যেটা হাত-পা বাদ দেওয়া। এত রক্ত কি আগে দেখেছে বস্টন?
ভয়াবহতার এই ভিড়ে আবার জেগে রয়েছেন জীবনের এক প্রবল বিজ্ঞাপন। বিল ইফরিগ, বয়স ৭৮। বস্টন ম্যারাথনের অন্যতম প্রতিযোগী তিনি, সম্ভবত প্রবীণতম। ইউটিউবে ইতিমধ্যে পোস্ট হওয়া বেশির ভাগ ভিডিওতেই দেখা যাচ্ছে, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় পড়ে গেলেন উজ্জ্বল কমলা গেঞ্জি পরা এক প্রবীণ। কয়েক জন পুলিশ ছুটে এলেন তাঁর কাছে। ওই প্রবীণই বিল ইফরিগ। সংবাদমাধ্যমের দৌলতে তিনিই এখন বস্টন বিস্ফোরণের ‘মুখ’। বিস্ফোরণ কিন্তু ছোবল বসাতে পারেনি তাঁর দেহে। পড়ে গিয়ে শুধু হাঁটুটা ছড়েছে। পরে বিল বলছিলেন, “আমার থেকে কয়েক ফুট দূরে ব্যাপারটা হল। অভিঘাতটা বোধহয় শরীরে লাগল। মনে হল, পা দু’টো ‘নুড্ল’ হয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারলাম পড়ে যাচ্ছি।” পড়ে গিয়েও নাকি তিনি জ্ঞান হারাননি। কী করলেন তখন? কয়েক বারের চেষ্টায় উঠে দাঁড়ালেন। খোঁড়াতে খোঁড়াতেই পেরিয়ে গেলেন ফিনিশিং লাইন। তখনও বোঝেননি ঠিক কী হয়েছে। দৌড় শেষের পর ছ’টা ব্লক পেরিয়ে নিজের হোটেলে ফিরে টিভি দেখে প্রথম জানতে পারেন বিস্ফোরণের কথা। এর আগে ৪৫টা ম্যারাথনে দৌড়েছেন বিল। বস্টনে ম্যারাথনে এই
নিয়ে তিন বার। জানালেন, নিজের বিভাগে এ বার দ্বিতীয় হয়েছেন। সিয়াটল থেকে ছেলে ফোন করেছিলেন। বাবার গলা শুনে আশ্বস্ত করেছেন বাড়ির সকলকে।
অনেক দূরে ডরচেস্টারে আর এক বিল-এর বাড়ির আনাচে কানাচে তখন স্তব্ধতা। বাস্কেটবল আর বেসবল নিয়ে যখন তখন মেতে যাওয়া, মায়ের হাত ধরে পাড়া বেড়াতে বেরোনো আট বছরের ফুটফুটে ছেলেটার কথা ফিরে ফিরে আসছে কান্না হয়ে। ছোট্ট একটা সাইকেল কাত হয়ে রয়েছে লনে। মার্টিনের আর ওটার প্রয়োজন নেই। |