|
|
|
|
|
|
মিউচুয়াল ফান্ড |
|
যে জন থাকে
মাঝখানে
নীলাঞ্জন দে |
|
সঞ্চয়ের দুনিয়ায় খুব পরিচিত শব্দবন্ধ কেওয়াইসি বা নো ইয়োর কাস্টমার। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ এটি ছাড়া গতি নেই। এ বার সেই কেওয়াইসি-র সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে আরও একটি শব্দবন্ধ আচমকাই তাত্পর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে মিউচুয়াল ফান্ডের চৌহদ্দিতে। আর সেটি হল কেওয়াইডি। পুরো কথা, নো ইয়োর ডিস্ট্রিবিউটর।
কেওয়াইডি
এখানে ডিস্ট্রিবিউটর বলতে সেই সমস্ত মধ্যস্থতাকারীর কথা বলা হচ্ছে, ফান্ড কেনার সময়ে যাঁদের সাহায্য চান সাধারণ লগ্নিকারীরা। শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি এখন নিয়ম করেছে, ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করতে গেলে কেওয়াইডি জমা দিতেই হবে। কাজেই ফান্ডে লগ্নির জন্য ভরসা করছেন যে-ডিস্ট্রিবিউটরকে, আগে তাঁকে জানুন আপনিও। দেখে নিন, তাঁর কেওয়াইডি করা আছে কি না।
তবে আমি এখানে ব্যক্তিগত ভাবে যাঁরা মিউচুয়াল ফান্ডের পেশাদার ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের কথাই বলছি। কর্পোরেট ডিস্ট্রিবিউটর অর্থাত্ যাঁরা কোনও সংস্থার পক্ষ থেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রয়েছেন, তাঁরা এই আলোচনার বাইরে।
তাঁরা কারা?
আপনি যদি মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নিকারী হন, তা হলে আপনার জীবনে ডিস্ট্রিবিউটরের ভূমিকা খানিকটা চড়াই-উতরাইয়ের পথে লাঠির সাহায্য নেওয়ার মতো। যেমন
• সম্পদ পরিচালনাকারী সংস্থায় (অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি) যাবেন ফান্ড কিনতে। আপনার এবং ওই সংস্থার মাঝখানে তাঁরা সেতু। কারণ ফান্ড কিনতে কোন কোন সংস্থার দরজায় যেতে পারেন, আপনি সেটা জানতে পারবেন তাঁর কাছ থেকেই।
• আপনি লগ্নির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। তাঁরা আপনার উপদেষ্টা। ফান্ডে কতটা তহবিল বিনিয়োগ করা ঠিক হবে, সেই পরামর্শ দিতে পারেন তিনি।
• বিনিয়োগের জন্য ফান্ড পছন্দ করতে বসেছেন। আপনার চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজারে কী কী ফান্ড আছে, তা চিনিয়ে দেবেন তাঁরা।
• রিটার্নের ভবিষ্যত্ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আপনি নেহাতই আনাড়ি। তাঁরাই বিভিন্ন ফান্ডের সুবিধা-অসুবিধার দিক ব্যাখ্যা করে তা বুঝিয়ে দেবেন।
• কোন ফান্ডে টাকা ঢালবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তাঁরা ফান্ড পছন্দ করে দেবেন। দেখা গেল, আপনি হয়তো সেটাই কিনলেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আপনার লগ্নি-জীবনে ডিস্ট্রিবিউটরদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং সেই কারণেই তাঁদের দায়িত্বের পাল্লাও বেশ ভারী। |
|
পালাবার পথ নেই
ইচ্ছে হল আর কেউ মিউচুয়াল ফান্ডের ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে গেলেন, এখন আর তা চলবে না। আসলে আমার-আপনার পুঁজির এতটা দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, তিনি ঠিকমতো কাজ করছেন কি না, বা দায়িত্বের অপব্যবহার করছেন কি না, সেই খবর না-রেখে উপায় নেই। শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবিরও এটাই মত। সাধারণ লগ্নিকারীর টাকা যাতে নয়ছয় না-হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই ডিস্ট্রিবিউটরদের চোখে চোখে রাখে তারা। আর সেই নজরদারিরই অন্যতম হাতিয়ার হল কেওয়াইডি।
বেশ কিছু দিন আগেই সেবি মিউচুয়াল ফান্ড ডিস্ট্রিবিউটরদের রেজিস্ট্রেশন বা নথিভুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে কড়া অবস্থান নিয়েছে। যেখানে তারা স্পষ্ট বলেছে, প্রত্যেক ডিস্ট্রিবিউটরকে নথিভুক্তির আবেদনপত্রে নিজের সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানাতে হবে। তবে সম্প্রতি সেই নজরদারির বাঁধন আরও শক্ত করেছে তারা। যার ফল এই কেওয়াইডি বিধি। ইতিমধ্যেই ফান্ডে লগ্নি কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়েছে সেটি। কেওয়াইডি আবেদনপত্র পূরণ করে সেবির কাছে জমা না-দিলে কেউ নিজেকে ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে দাবি করতে পারবেন না। তবে ব্যক্তি হিসেবে একজন ডিস্ট্রিবিউটর এবং একজন কর্পোরেট ডিস্ট্রিবিউটরের মধ্যে ওই আবেদনের শর্তে ফারাক আছে।
|
সতর্ক হলে পকেট বাঁচবে
জীবনের যে কোনও মুহূর্তেই কথাটা সত্যি। ফান্ডে লগ্নির ক্ষেত্রে তো বটেই। বিশেষত যখন ডিস্ট্রিবিউটরের প্রসঙ্গ আসে। আপনার টাকা নয়ছয় হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব আপনারই। তাই প্রথমেই নিশ্চিত করুন, যে মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে পুঁজির ভবিষ্যত্ নির্ধারণের রাস্তায় হাঁটছেন, তিনি অন্তত বেশি কমিশন পকেটে পোরার চক্করে আপনার পকেট ফুটো করছেন না।
কী ভাবে বুঝবেন এ রকম কোনও ঘটনা ঘটছে না? খেয়াল রাখুন
• মুনাফা ঘরে তোলার তাগিদে আপনি নিজে কতটা ঝুঁকি নিতে পারেন, সেটা আগে যাচাই করুন।
• আপনার ঝুঁকি ও চাহিদা অনুযায়ী তহবিল বণ্টন হচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখুন।
• চূড়ান্ত পর্যায়ে টাকা লাগানোর আগে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজুন
ক) ডিস্ট্রিবিউটর কি এমন সব ফান্ডের সুপারিশ করছেন, যেগুলি আপনার চাহিদার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না?
খ) আপনার কি মনে হচ্ছে যে, ডিস্ট্রিবিউটর বেশি কমিশনের লোভে এমন ফান্ড কেনার পরামর্শ দিচ্ছেন, যার প্রয়োজন নেই?
গ) তিনি কি আপনাকে খুব দ্রুত লেনদেনে উত্সাহ দিচ্ছেন? আর তার দরুন কিছু দিন পর পরই তহবিল বণ্টনের ছক বদলাতে হচ্ছে?
বারে বারে তহবিল এ দিক-ও দিক করার মানে দ্রুত ফান্ড কেনা-বেচা করা। যেটা শেষমেষ ডিস্ট্রিবিউটরকেই বেশি আয়ের সুযোগ করে দেয়।
• নজর রাখুন লগ্নির খুঁটিনাটির উপর। এটা কিন্তু অসম্ভব জরুরি।
• আপনার পছন্দ করা ফান্ডের প্রতিযোগী হিসেবে এখন যেগুলি বাজারে বিক্রি হচ্ছে, সেগুলি সম্পর্কে অন্তত কাজ চালানোর মতো জ্ঞান অবশ্যই অর্জন করুন। তাতে বাজার সম্পর্কে নিজের ধারণা তৈরি হবে।
|
জানেন কি? |
• ফান্ড সম্পর্কে ডিস্ট্রিবিউটর আপনাকে ভুল বোঝালে, তা বেআইনি।
• পছন্দের ফান্ড বেচতে আপনার কাছে কোনও তথ্য গোপন করলে, সেটাও বিধি বহির্ভূত কাজ।
• তাঁর দায়িত্ব আপনার পছন্দ ও চাহিদার সঙ্গে খাপ খায়, এমন ফান্ড কিনতে সাহায্য করা।
• আপনি আবেদনপত্র ঠিকঠাক ভর্তি করতে পারলেন কি না, সেটা দেখাও তাঁর অন্যতম কর্তব্য।
• আবেদনপত্রে আপনার দেওয়া তথ্য বদলানোর অধিকার ডিস্ট্রিবিউটরের কখনওই নেই। |
|
জেনে এগোন
বেশি কমিশনের জন্য অনেক ডিস্ট্রিবিউটরই ক্রেতার চাহিদা এড়িয়ে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকেন। তাই সেবি চাইছে, লগ্নিকারী ফান্ড কেনার সময়ে অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে ডিস্ট্রিবিউটরের কমিশনের অঙ্কও জেনে নিন, যেহেতু মূলত তাঁর সুপারিশেই লগ্নিকারী ওই ফান্ডটি কিনছেন। এ ছাড়া, লগ্নিকারীদের প্রতি মধ্যস্থতাকারীদের আচরণ কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে সেবির নির্দেশিকাও আছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে লগ্নিকারীরা যা যা মাথায় রাখবেন, সেগুলি হল
• ডিস্ট্রিবিউটর ফান্ডের রিটার্ন সম্পর্কে ক্রেতাকে নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। বিশেষত লগ্নিকারী যদি ওপেন এন্ড ইক্যুইটি ফান্ড কেনার দিকে ঝোঁকেন। কারণ এই ফান্ডের লাভ-ক্ষতি পুরোপুরি বাজারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। আর বাজারের ওঠা-নামা সম্পর্কে আগাম কিছুই বলা সম্ভব নয়।
• লগ্নিকারীকে বেআইনি বা ভুল পথে মুনাফা বাড়ানোয় উত্সাহ দেওয়া চলবে না। যেমন, চেক বাউন্স করা বা ডিভিডেন্ড পাওয়ার কথা না-থাকলেও ইচ্ছাকৃত ভাবে তা দাবি করা ইত্যাদি কাজে ইন্ধন জোগানো চলবে না।
• ফান্ড কিনতে গিয়ে লগ্নিকারী যেন ভাগে ভাগে আবেদনপত্র জমা না দেন। অনেক সময়ে ডিস্ট্রিবিউটরই এই পরামর্শ দেন নিজের পকেট ভারী করতে। কিন্তু এটা নীতি বহির্ভূত কাজ।
|
আতস কাচের তলায়
এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলি মাথায় না-রেখে এগোলে পরে হাত কামড়াতে হতে পারে। সেগুলিতে এক বার চোখ বুলিয়ে নিন
• দেখে নিন, যে ডিস্ট্রিবিউটরকে বাছলেন, তাঁর ভাল পরিষেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো আছে কি না। কারণ, আপনার আবেদনপত্র, চেক ইত্যাদি যত্ন সহকারে সামলানোর দায়িত্ব তো তাঁরই।
• ডিস্ট্রিবিউটর যেন কোনও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বা ফান্ড সম্পর্কে ভুলভাল বোঝাতে না- পারেন। বার বার বলছি, এ বিষয়ে কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে আপনাকে।
• আপনার ডিস্ট্রিবিউটর মিউচুয়াল ফান্ড সংক্রান্ত বিধি বা আইনে সাম্প্রতিক কালে কী কী পরিবর্তন এসেছে, সে সম্পর্কে খবর রাখেন তো? না হলে আপনাকে তিনি ভাল পরিষেবা দেবেন কী করে? বিশেষ করে লোড সংক্রান্ত কোনও অদলবদল ঘটে থাকলে, সেটা লগ্নিকারী হিসেবে আপনার জানা খুব জরুরি। লোড হল ফান্ড কিনতে ঢোকা (এন্ট্রি লোড) বা তা বিক্রি করে বেরোনোর (এক্সিট লোড) সময়ে ক্রেতাকে ন্যাভের উপর যে-হারে চার্জ দিতে হয়। তবে সব ফান্ডের ক্ষেত্রে যে সব সময়ে লোড দিতেই হবে তা নয়। ফান্ড অনুযায়ী বা সেখানে ঢোকা বা বেরোনোর সময় অনুযায়ী তা সংস্থাই ঠিক করে দেয়। তবে লোড বাড়লে লগ্নিকারী হিসেবে আপনার খরচ বাড়বে। কাজেই এই সংক্রান্ত তথ্য জানানোটাও ডিস্ট্রিবিউটরের কাজের মধ্যেই পড়ে।
• আপনার পুঁজির নিরাপত্তার খাতিরে লগ্নির গোপনীয়তা বজায় রাখা খুব জরুরি। আর ডিস্ট্রিবিউটরের প্রাথমিক গুণ এই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা। ডাক্তার যে-ভাবে তাঁর রোগী বা আইনজীবী তাঁর মক্কেল সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন, ডিস্ট্রিবিউটরেরও তাঁর কাছে আসা লগ্নিকারীর লেনদেন সম্পর্কে অন্য কারও কাছে মুখ খোলা উচিত নয়।
• সর্বোপরি ডিস্ট্রিবিউটর আপনার স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এগোচ্ছেন কি না, তা একটু যাচাই করে নিন। মনে রাখবেন, পছন্দের ফান্ড যেন আপনার সত্যিকারের চাহিদাগুলি পূরণ করতে পারে। ফান্ড কেনার দৌলতে আপনার ডিস্ট্রিবিউটর কমিশন বা ইনসেনটিভ, যা-ই পান না কেন, সেটা কিন্তু কখনওই আপনার লগ্নির দিশা স্থির করার ভিত্তি হতে পারে না।
|
লেখক উইশলিস্ট ক্যাপিটাল অ্যাডভাইজর্সের ডিরেক্টর
(মতামত ব্যক্তিগত) |
|
|
|
|
|