ছোট ব্যবসায়ীর কর
কে বলল, কর
দেওয়া মানেই ঝক্কি?
চাকুরিজীবী বা বড়-মাঝারি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির আয়করের হিসেব-নিকেশ নিয়ে বিস্তর কথা হয়। কিন্তু অফিসের পাশে চাওয়ালা বা পানওয়ালা দাদা, বাড়ির সামনে যাঁর মুদি দোকান থেকে রোজকার চাল, ডাল কিনি, পাড়ার মিষ্টির দোকান কিংবা আমাদের স্বাদ-আহ্লাদ মেটাতে যে অসংখ্য খুচরো বিক্রেতা গিজগিজ করছে চারদিকে, তাঁরা? এঁদের আয়কর নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। অথচ এই রকম ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের আয়কর হিসাবের জন্য বেশ সহজ সরল একটা বন্দোবস্ত, ‘প্রিসামটিভ ইনকাম স্কিম’ বা আনুমানিক আয় প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু যাঁদের জন্য এই ব্যবস্থা, তাঁরা নিজেরাই কি আদৌ এর খবর রাখেন?

না-জানার ভয়
ছোট মাপের ব্যবসা হলে সাধারণত আলাদা করে অ্যাকাউন্ট বুক (বিস্তারিত হিসাবের খাতা-পত্র) রাখার মতো পরিকাঠামো থাকে না অনেকেরই। যেমন, পানের দোকান। দোকানি ব্যবসার লাভ-ক্ষতির হিসেব করেন অবশ্যই। কিন্তু তাঁর পক্ষে কি নিয়ম মেনে অ্যাকাউন্ট বুক লেখা সম্ভব? অথচ আইন অনুযায়ী, তিনি বা তাঁর মতো ছোট ব্যবসাদারদের আয় যদি করযোগ্য হয়, তা হলে আয়কর রিটার্ন তো জমা দেওয়াই উচিত।
আসলে ছোটকরদাতাদের মধ্যে আয়কর হিসাব করার ব্যাপারে এক ধরনের ভয় কাজ করে। তাঁরা আগে থেকেই ভেবে নেন যে, রিটার্ন জমা দেওয়া খুব ঝামেলা-ঝক্কির কাজ। কিন্তু সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সত্যি নয়। বরং আমি বলব, ছোট ব্যবসায়ীদের নিজেদের স্বার্থেই জেনে রাখা উচিত তাঁদের আয়কর কী ভাবে হিসাব হবে, সে জন্য কী করতে হবে এবং সেই সঙ্গে রিটার্ন জমা দেওয়ার খুঁটিনাটি।

আনুমানিক আয়ের উপর কর
আয়কর আইনের ৪৪এডি ধারায় ছোট ব্যবসাদারদের আয়কর হিসাবের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলা আছে। অনুমানিক আয়ের ভিত্তিতে সেখানে দেয় কর হিসাব করা হয়। ওই ধারা অনুযায়ী, আনুমানিক আয় প্রকল্পের আওতায় পড়বেন সেই সব ব্যবসায়ী, যাঁদের মোট ব্যবসা (টার্নওভার)/ বিক্রি (সেল)/হাতে আসা মোট টাকার পরিমাণ (গ্রস রিসিপ্ট) বছরে এক কোটি টাকা পেরোবে না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির (ব্যবসার মালিক) আয় বা মুনাফা ধরা হবে তাঁর মোট ব্যবসা বা বিক্রি বা গ্রস রিসিপ্টের ৮ শতাংশের সমান। এবং তার উপর কর দিতে হবে। ভারতে বসবাসকারী কোনও ব্যক্তি নাগরিক, হিন্দু অবিভক্ত পরিবার ও অংশীদারি সংস্থা বা পার্টনারশিপ ফার্ম (নিয়ন্ত্রিত দায়ের অংশীদারি সংস্থা বা limited liability partnership firm বাদ দিয়ে) এর সুবিধা নিতে পারেন।

আওতায় যাঁরা
যে কোনও ব্যবসাই আনুমানিক আয়ের ভিত্তিতে কর দেওয়ার এই সুবিধা নিতে পারে। যেমন ছোট খুচরো দোকান, পানের দোকান, মিষ্টির দোকান, মুদি দোকান, চায়ের দোকান, পণ্য-সামগ্রী সামলানোর ব্যবসা, কারখানা রক্ষণাবেক্ষণ, কেব্‌ল লাইন পাতা বা মাটি খোঁড়ার জন্য ও কারখানায় সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করার জন্য মজুর জোগানের ঠিকাদার সংস্থা, রেল লাইন লাগানো (জয়েনিং) ও সারানোর পরিষেবা, সিলিন্ডার পরীক্ষা ও সারানোর ব্যবসা, ঘরবাড়ি রং ও চুনকাম করার কাজ, বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ কাজের জন্য বাঁশ সরবরাহের ব্যবসা, জামা-কাপড় তৈরি, নির্মাণ কাজের বরাত, সেই কাজে মজুর জোগানের ব্যবসা ইত্যাদি।
ছোট ছোট উত্‌পাদনকারীও (স্মল ম্যানুফ্যাচারার্স) প্রকল্পের আওতায় পড়বেন, যদি তাঁদের বিক্রির অঙ্ক এক কোটি টাকা না ছাড়ায়। গত ২০১২-’১৩ অর্থবর্ষ ও তার পরবর্তী সময় থেকে প্রযোজ্য এই ঊর্ধ্বসীমা। যেমন, একজন মিষ্টি ব্যবসায়ীর যদি অনেকগুলি দোকান থাকে এবং সেগুলির থেকে তাঁর মোট ব্যবসা বা বিক্রি গত ২০১২-’১৩ সালে এক কোটি টাকা না পেরিয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে তিনি এই সুবিধা পাবেন।

কারা বাদ
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই প্রকল্প প্রযোজ্য হবে না। যেমন
ক) ৪৪এএ(১) ধারা অনুযায়ী, আইন, চিকিত্‌সা, ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্যপ্রযুক্তি, অন্দর সজ্জা (ইন্টেরিয়ার ডেকরেশন) ক্ষেত্রের পেশাদার, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কোম্পানি সেক্রেটারি, টেকনিক্যাল কনসালট্যান্সি, চলচ্চিত্র অভিনেতা, ট্রাইবুনালে যাঁরা মক্কেলের হয়ে কাজ করেন ইত্যাদি।
খ) কমিশন বা ব্রোকারেজ হিসেবে রোজগার করেন যে ব্যক্তি।
গ) কোনও ধরনের এজেন্সি হিসেবে ব্যবসা চালান যে ব্যক্তি।
ঘ) যে আয়করদাতা ১০এ, ১০এএ, ১০বি, ১০বিএ ধারা অনুযায়ী কিংবা ৮০এইচএইচ থেকে ৮০আরআরবি পর্যন্ত ধারার আওতায় কর ছাড় দাবি করেছেন।
ঙ) পণ্য-পরিবহণ ব্যবসায় যুক্ত যাঁরা। এঁদের আলাদা কর ব্যবস্থা আছে।

মাথায় রাখুন
আনুমানিক আয় প্রকল্পের সুবিধা নিতে চান? তা হলে কিছু বিষয় মনে রাখুন
• আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পার্মান্যান্ট অ্যাকাউন্ট নম্বর (প্যান) জরুরি। প্যান-এর জন্য আবেদন করতে ফর্ম ৪৯এ জমা দিন। ওয়েবসাইট থেকে ফর্মটি বার করে নিতে পারেন। নিজের না-থাকলে, আশেপাশে চেনা-জানা যাঁর কম্পিউটার আছে, তাঁকে বলুন law.incometaxindia.gov.in/DITTaxmann/IncomeTaxRules/pdf/Form49aE.PDF কিংবা www.tin-nsdl.com/download/pan/Form49A/pdf লিঙ্ক খুলে আবেদনপত্রটি বার করে দিতে। আবেদন করার খরচ ১০০ টাকার কম।
• ব্যবসার ৮% আয় দেখালে অ্যাকাউন্ট বুক রাখতে হবে না।
• কিন্তু আয় বা মুনাফা ৮ শতাংশের কম দেখালে এবং মোট আয় যদি কর ছাড়ের সীমা থেকে বেশি থাকে, তবে অ্যাকাউন্ট বুক রাখতে হবে এবং ৪৪এবি ধারায় অ্যাকাউন্ট অডিট হবে।
• আনুমানিক আয়কে নিট করযোগ্য আয়ই ধরা হবে। ৩০ থেকে ৩৮ নম্বর ধারায় রক্ষণাবেক্ষণ বা ওই ধরনের কোনও খরচ/ভাতা আনুমানিক আয় থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। তবে অংশীদারের বেতন বা পারিশ্রমিক এবং মূলধনের যে অংশের উপর তাঁকে সুদ দিতে হয় (৪০(বি) ধারায় অবশ্য কিছু শর্ত ও ঊর্ধ্বসীমা রয়েছে), সেই অঙ্ক ৮ শতাংশের আয় থেকে বাদ যাবে।

কর দিলে দেশের লাভ
করদাতার সংখ্যা বাড়িয়ে রাজকোষ আরও ভরার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে এই আনুমানিক আয় প্রকল্প। তবে সে জন্য সরকারকেই আরও উদ্যোগী হতে হবে। যেমন
• কল্পটি ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে ঠিক মতো ব্যাখ্যা করে তাঁদের আয়কর দানে উত্‌সাহী করে তুলতে হবে।
• করদাতাদের সচেতনতা ও শিক্ষা প্রসারে টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
• কম রোজগেরে দেশবাসীর মধ্যেও কর দেওয়ার সুস্থ সংস্কৃতি (ট্যাক্স কালচার) গড়ে তোলায় মন দিতে হবে।
• যে সমস্ত করদাতা এ সব ব্যাপারে ততটা শিক্ষিত বা দক্ষ নন, তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে আয়কর দফতরের কর্মীদের।
• আনুমানিক আয় প্রকল্পের পরিসর বাড়াতে হবে।
• সে ক্ষেত্রে আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ডাক্তার, আর্কিটেক্ট, অভিনেতা ইত্যাদি পেশাদারদেরও এর আওতায় আনা যায়। তাঁদের ক্ষেত্রে নিট আয় হিসাব করা যেতে পারে মোট ব্যবসার ১০% ধরে।
• ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো বা প্রাইভেট টিউশনকে এই প্রকল্পের আওতায় আনলে ভাল হয়।

লেখক আইনজীবী ও কর সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.