নাকে খতটুকু বাকি ছিল। তবে জেরার মধ্যেই গোয়েন্দাদের সামনে কান ধরে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘এটাই শেষ। আর কোনও দিন করব না স্যার।’ লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের চারতলা বাড়ির তেতলায় ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার অফিসে অভিনীত এই দৃশ্যটি পাঁচ বছর আগের। মেঝেতে থেবড়ে বসে ছিলেন সাড়ে ১০ কোটি টাকা জালিয়াতিতে ধৃত এক ব্যক্তি। জেরা করা হচ্ছিল তাঁকে। তখনই কান মলতে মলতে তিনি বলছিলেন, ‘এটাই শেষ...।’
কিন্তু গোয়েন্দারা এখন দেখছেন, পাঁচ বছর পরেও ইন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায় একটুও শোধরাননি। বরং আরও বড় জালিয়াতিতে জড়িয়েছেন নিজেকে। গোয়েন্দাদের সামনে নিজের হাতে কান মলে তখন যে-প্রতিশ্রুতিই দিন না কেন, এ বার সেই একই ইন্দ্রজিৎ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা জালিয়াতিতে অভিযুক্ত। এবং ধরা পড়েছেন সেই ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার হাতেই। এক গোয়েন্দা অফিসার পাঁচ বছর আগে কান মলে বলা তাঁর কথা দেওয়ার বিষয়টি ইন্দ্রজিৎকে মনে করিয়ে দেন। এ-যাত্রা ইন্দ্রজিৎ অবশ্য চুপ। তাঁর দৃষ্টি তখন মেঝের দিকে।
তদন্ত এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে এ বার ইন্দ্রজিতের জালিয়াতির অঙ্কটাও যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দাদের মনে হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের ১২০ কোটি, স্টেট মার্কেটিং বোর্ডের ১৭ কোটি এবং প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ কোটি টাকা তছরুপের ঘটনায় ইন্দ্রজিৎ নাটের গুরু। কিন্তু সেই সঙ্গে রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কের ৬০ কোটি টাকা তছরুপেও ইন্দ্রজিৎই যে মূল পাণ্ডা, সেই ব্যাপারে গোয়েন্দাদের সন্দেহ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। সেটা ঠিক হলে পাঁচ বছর পরের এই ইন্দ্রজিৎ ২০২ কোটি টাকা তছরুপে জড়িত বলে তদন্তকারীদের অভিমত।
গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এই দফায় ইন্দ্রজিৎ তছরুপের টাকার একটা বড় অংশ দিয়ে বিস্তর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি করেছেন। পাঁচ বছর আগে তদন্তে গোয়েন্দারা দেখেছিলেন, ব্যাঙ্ক জালিয়াতির টাকার বেশির ভাগটাই ইন্দ্রজিৎ ব্যয় করেছিলেন বিলাসবহুল জীবনযাপনে। কিছুটা টাকা ঢালেন টলিউডে একটি ছবি তৈরির পিছনে।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “ইন্দ্রজিৎ স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ৬০ কোটির সম্পত্তির কথা স্বীকার করেছে। মূলত দক্ষিণ শহরতলিতেই জমি ও ফ্ল্যাট কিনেছে সে। বলিউডে ছবি তৈরির জন্যও এ বার সে ঢেলেছে সাত কোটি টাকা।”
গোয়েন্দাদের একাংশের বক্তব্য, ইন্দ্রজিৎ এই প্রথম সম্পত্তি করার পিছনে টাকা ঢেলেছে। এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, “এ বার জালিয়াতি করে বিপুল টাকা আত্মসাতের পরেও ইন্দ্রজিতের সম্ভবত ধারণা হয়েছিল, তাকে কেউ ছুঁতে পারবে না। কিছুটা বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল সে। আগে যেটা দেখা যায়নি।” তবে বিলাসবহুল জীবনযাপন এ বারেও কিছু কম ছিল না। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, ইন্দ্রজিতের বাড়িতে রান্না প্রায় হতই না। দুপুর ও রাতের খাবার নিয়মিত আসত শহরের বিভিন্ন দামি রেস্তোরাঁ থেকে।
তদন্তকারীরা জেনেছেন, নতুন পর্যায়ে ইন্দ্রজিতের তছরুপের পালা শুরু হয় গত বছরের জুলাই-অগস্টে। তার কিছু দিনের মধ্যেই মধ্য কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে প্রায় ৪০০ লোককে আমন্ত্রণ করে বড় মাপের ‘পার্টি’ দিয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎ। রাজ্য প্রশাসনের প্রভাবশালী কয়েক জন ব্যক্তি সেই পার্টিতে হাজির ছিলেন বলেও লালবাজার সূত্রের খবর।
এক গোয়েন্দাকর্তার কথায়, “পার্টিতে প্রশাসনের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা নিজের ছবিকে মূলধন করে সরকারের বিভিন্ন মহল ও ব্যাঙ্কের কর্তাদের প্রভাবিত করেছিল ইন্দ্রজিৎ। এতে নতুন দফায় তার জালিয়াতির রাস্তা মসৃণ হয়েছিল।”
|