একজনের দাম সাড়ে ন’কোটি। একজনের দাম আড়াই কোটির কিছু বেশি। মঙ্গলবার মোহালিতে সাড়ে বারো কোটি-র মিলিত প্যাকেজের অবদান কী?
কোনও আইপিএল নেশাতুরকে জিজ্ঞেস করলে জবাব হিসেবে পেতেই পারেন বিখ্যাত জীবনমুখী গায়কের গানের সেই লাইনটা।
‘প্রশ্নটা খুব সহজ আর উত্তরও তো জানা!’
দুই ক্রিকেটারের নাম অবশ্যই ইউসুফ পাঠান আর মনোজ তিওয়ারি। পঞ্চনদের তীরে নাইট স্বপ্নের সলিলসমাধির দিনে দুই টি-টোয়েন্টি দিগ্গজের মিলিত অবদান ২৩ বল খরচ করে মাত্র ১৪ রান! ডট বলের হিসেব পাঠানের ন’টা, মনোজের ছ’টা। ‘নয়-ছয়’ করে হারা আর কাকে বলে!
আইপিএলের বাজারে ১৫৭ টার্গেট হিসেবে দারুণ ভয়াবহ কিছু নয়। বিশেষ করে বিপক্ষের নাম যদি হয় কিংস ইলেভেন পঞ্জাব। প্রথম দু’ওভারে মনবিন্দর বিসলা আর জাক কালিস ডাগআউটে ফিরে এলেও তাই জয়ের স্বপ্নটা ভাল মতোই ছিল নাইট ভক্তদের মনে। গৌতম গম্ভীর আর ওয়েন মর্গ্যান যখন দু’দিক থেকেই পেটানোর কাজটা করে যাচ্ছেন, সাড়ে বারো ওভারেই যখন টিম একশোর গণ্ডি টপকে গিয়েছে, তখন ১৫৭ উঠবে না?
নাহ, উঠল না।
এবং কেন উঠল না এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই খলনায়ক হিসেবে ভেসে উঠবে বারো কোটির ওই মিলিত প্যাকেজ। |
মনোজ যখন ব্যাট হাতে মোহালির বাইশ গজে নামছেন, ৪১ বলে তখন নাইটদের চাই ৫২। কুড়ি ওভারের ইন্সট্যান্ট ক্রিকেটের যুগে যে রানটা না ওঠাই বিস্ময়কর। আইপিএল ফোর থেকে কলকাতার হয়ে খেলা মনোজ বাংলার বাকি ক্রিকেটারদের তুলনায় নিয়মিত প্রথম এগারোয় সুযোগ পেয়ে আসছেন। আর সেই সুযোগ কাজে লাগাতে নিয়মিত ব্যর্থও হয়ে চলেছেন। চেন্নাইয়ে আইপিএল ফাইভ-এর ফাইনাল বাদ দিলে মনোজ ক’বার ম্যাচ শেষ করে এসেছেন, রেকর্ড ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাত ব্যথা হতে বাধ্য। ইডেনে হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে তাঁকে বসিয়ে মর্গ্যানকে আগে পাঠানো নিয়ে নাকি বিরক্ত ছিলেন মনোজ। মোহালিতেই তো ছিল সেই উপেক্ষার জবাব দেওয়ার সেরা মঞ্চ। তার বদলে কেন ম্যাচ শেষে শুনতে হবে কেকেআর ক্যাপ্টেনের আক্ষেপ, “মর্গ্যান আর আমারই উচিত ছিল ম্যাচটা ফিনিশ করে আসা!”
আর পাঠান? ক্যাপ্টেনের পরম আস্থাভাজন ইউসুফ পরের পর ম্যাচে এক অঙ্কের স্কোরে আটকে থাকছেন। তবু ম্যাচের পর ম্যাচ তাঁকে নামানো হচ্ছে। রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে যে জোশ তাঁর ব্যাটে বারবার দেখা গিয়েছে, পুরনো টিম ছেড়ে আসার সময় সেই ফর্মটাও বোধহয় রাজস্থানের মরুভূমিতে ফেলে এসেছেন ইউসুফ। যতই বিয়ের পরপর জার্সির নম্বর পাল্টে ‘৯৯৯’ রাখুন, রান-ভাগ্য আর ফিরছে না। ৩০ বলে দরকার ৪২ এই অবস্থায় টিমকে বাকি রাস্তাটা উতরে দেবেন না? ইউসুফ থাকতে কেন শেষ ওভারে ১১ তোলার চাপটা নিতে হবে সুনীল নারিনদের মতো টেলএন্ডারদের? কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে একটা পুরো ওভার রান না নিয়ে ক্রিজ আঁকড়ে পড়ে রইলেন সিনিয়র পাঠান! ওই একটা ওভার তাঁকে ‘চোক’ করে যেতে দেখেই বোধহয় পরের ওভারে পরবিন্দর আওয়ানাকে চোখ-কান বুজে চালাতে গেলেন মনোজ। বলটা ব্যাট ছুঁল না, স্টাম্পটা স্রেফ নড়িয়ে দিল।
মিডল অর্ডারের ব্যর্থতা নাইটদের অপমৃত্যুর এক নম্বর কারণ হলে, দুই, তিন এবং চার যথাক্রমেসুনীল নারিন। |
দুরন্ত ব্যাট করলেও মোহালিতে মঙ্গলবারটা গম্ভীরের দিন ছিল না। |
মনপ্রীত গোনি। এবং ‘বুড়ো’ গিলক্রিস্ট। শেষ ওভারের প্রথম বলটা ওয়াইড সমেত পাঁচ রান হয় নির্ঘাত। আর হলে মিনিট পাঁচেক পর প্রবীণ কুমারের লম্ফঝম্ফও দেখতে পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু একচল্লিশের গিলি যে ভাবে বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে নিশ্চিত চারটে রান বাঁচিয়ে দিলেন, তাতে তাঁর সমালোচকদের চোয়াল ঝুলে যাওয়ার কথা!
ঠিক ততটাই বিস্ময়কর (নাকি আরও বেশি) নারিনের এক ওভারে ২৩ দেওয়া! আইপিএল কেরিয়ারে নিজের প্রথম হ্যাটট্রিকটা (নাইটদেরও প্রথম) করার এক ওভার পরেই ২৩! একটা গোটা টুর্নামেন্টের নায়ক মাত্র ছ’টা বলের ব্যবধানে হয়ে দাঁড়ালেন ম্যাচের খলনায়ক! যা নিয়ে ম্যাচ শেষে বেশ বিরক্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট বাছতে বসে যার জন্য দু’বার না ভেবে নিজের ওই ২৩ রানের ওভারটাকেই ‘ম্যাচ কা মুজরিম’ হিসেবে তুলে ধরলেন হ্যাটট্রিক বোলার। বলে দিলেন, “ডেথ ওভারের বোলিংই আজ আমাদের হারিয়ে দিল। বিশেষ করে আমার ওই ওভারটা।” |
অন্ধকারের নাইটরা
বিস্তারিত স্কোর... |
ইউসুফ পাঠান
|
মনোজ তিওয়ারি |
মনবিন্দর বিসলা |
ম্যাচ ৩২ রান ৪৭৭,
উইকেট ১৬
এ বার আইপিএলে
ম্যাচ ৫ রান ৬১ গড় ২০.৩৩
স্ট্রাইক রেট ১১২.৯৬,
সর্বোচ্চ ২৭ |
ম্যাচ ৪৪
রান ৮৫৬
এ বার আইপিএলে
ম্যাচ ৫ রান ৬১ গড় ১৫.২৫
স্ট্রাইক রেট ১০৩.৩৮,
সর্বোচ্চ ২৩ |
ম্যাচ ১২
রান ২৮৫
এ বার আইপিএলে
ম্যাচ ৫ রান ৩৪ গড় ৬.৮০
স্ট্রাইক রেট ৭৯.০৬,
সর্বোচ্চ ২৮ |
|
তা-ও দিনের শেষে নারিনের কপালে হয়তো খলনায়কের তকমাটা জুটত না। যদি পঞ্জাব টিমে ‘এমএসজি’ না থাকতেন। পেপসি আইপিএলে এই প্রথম সুযোগ পেলেন মনপ্রীত সিংহ গোনি। আর নেমেই ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’। পঞ্জাব ব্যাটিংয়ে যখন অদূরের দিল্লি-ভূমিকম্পের কম্পন লাগার জোগাড়, ব্রেট লি যখন হাসতে হাসতে সেনানায়কে-নারিন জুটির প্রশংসায় মেতে, সেই মোক্ষম সময় এল গোনির ১৮ বলে ৪২। এখানে শেষ হলে তা-ও নাইটদের চিত্রনাট্য ঠিকঠাক এগোতে পারত। বল হাতেও যে সোনালি-বেগুনি ব্যাটিং দুর্গে হামলা চালালেন গোনি। চার ওভারে খরচ মাত্র ১৮ রান। কেকের উপর আইসিং? কেকেআর ক্যাপ্টেনের উইকেট।
নিটফল, পঞ্চনদের তীরে নাইটদের পাঁচে তিন। জয়ের না, হারের!
|