আনন্দবাজারের পাতায় বড় ছবি, প্রথিতযশা শিল্পীরা বুকে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে বসে আছেন। কারও গলায় ‘ধিক্কার দিচ্ছি’, কারওর গলায় ‘ছিঃ’। যে কারণে ওই প্রতিবাদী ভাষার প্ল্যাকার্ড-লিখন, সেই কারণটা সত্যি ধিক্কার দেবার মতোই। খুব কম বয়স থেকেই বামপন্থী রাজনীতির বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে, তাঁদের স্নেহচ্ছায়ায় আমার জীবন চলা। সরকারি চাকরি খুইয়েছি গণনাট্য সংঘ করার অপরাধে। তবু সেই সব আলোর পথযাত্রীর প্রেরণায় জীবনে যে ছোট্ট প্রদীপ জ্বলেছে তার কারণ, তাঁদের মধ্যে যে মানবতার, শিক্ষার, রুচির, শিল্পবোধের মহান আদর্শের জ্যোতি দর্শন করেছি তা আমায় বেদমন্ত্র শুনিয়েছে, ‘সমানোমন্ত্রসমিতি সমানি’। তাঁদের মধ্যে দেখেছি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মর্মানুভূতি। যুদ্ধ, নীতির সঙ্গে নীতির, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নয়। আজ যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ, কাল সে জ্যোতি বসুর। সে-ই আবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ, সে-ই এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ। তাই প্রয়োগটার মধ্যে যে রাজনৈতিক বিন্যাস সেটাই প্রধান বিচার্য হওয়া উচিত, যে রাজনীতি অবশ্যই ব্যক্তি-কেন্দ্রিক না, নীতি-কেন্দ্রিক। |
আমি রাজনীতিক না, শিল্পী। আমার চিন্তা, ভাবনা, ভাব, দর্শন প্রকাশ প্রয়োগের সঙ্গে নান্দনিক বোধই মূল উৎস-সূত্র। তাই রাজনীতির কথা বলার অধিকার আমার নেই। হ্যাঁ, এক জন নাগরিক হিসেবে মনে হয় অনেক কথা। যেমন, কেন চেতনার লড়াই ব্যক্তির লড়াই হয়ে কাদা-ছোড়াছুড়িতে পৌঁছে যায়, যে দল পশ্চিমবঙ্গ থেকে সব সময় অধিক প্রতিনিধি পাঠায় সে দলে কেন দিল্লি সর্বদাই নির্দেশ জারি করবে এবং পশ্চিমবঙ্গের শ্রম-সাধনায় অর্জিত কর্মভূমিকে ভুল পদক্ষেপে বিষাক্ত করে দেবে? সেই ভাবেই মনে হয়েছে, কেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রদ্ধেয় অমিত মিত্রের ওপর ব্যক্তি-আক্রমণ রাজনৈতিক শিষ্টতা হিসেবে গণ্য করা হল? তাই আমার অনুজ-অনুজা সম শিল্পীদের মনে ধিক্কারবোধ ও ছিঃ-বোধের উদ্বোধন হওয়া অস্বাভাবিক না। আবার আমার প্রশ্ন জাগছে, মনে হয়েছে, দিল্লির ঘটনা যতই ন্যক্কারজনক হোক, এর সূত্রপাত তো এখানে না। এক মর্মান্তিক অকালমৃত্যুকে ঘিরে যে ঘটনার সূত্রপাত, সে ঘটনাও কি দল-রাজনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে, মানবতার বোধ-স্পর্শী শিল্পীদের নান্দনিক অনুভবে স্থান পাওয়ার দাবি করতে পারে না? প্রতিভাদীপ্ত সুদীপ্ত গুপ্ত-র প্রাণহীন দেহ যখন কাটাছেঁড়া হচ্ছে তখন তাঁর বেদনাকাতর পিতা গৃহের দ্বিতলে বেহালায় বাজিয়ে চলেছেন পুরানো সেই দিনের কথা, সঙ্কোচের বিহ্বলতা, তখন এই মানবিক বোধ-সম্পৃক্ত শিল্পীদের মনে রবীন্দ্রনাথের সেই সুর বেদনা হয়ে পৌঁছনোর কারণ ঘটেনি কেন?
সুদীপ্ত গুপ্তের মৃত্যুর রাজনৈতিক বিশ্লেষণে মতপার্থক্য থাকতে পারে, আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু তার অকালপ্রয়াণ কি শিল্পী মনের কোমল বৃত্তি স্পর্শ করার প্রত্যাশা করতে পারে না? শিল্পীদের নান্দনিক বোধ কি দলতন্ত্রের দাসত্ব করবে, না মানবতার মর্মধ্বনির প্রতিধ্বনিতে ঝংকৃত হবে? আমার মনে এই প্রশ্ন তোলপাড় করছে শিল্পীদের ওই ধর্না-দৃশ্য দেখে। দিল্লির ঘটনা যাঁদের এত বিচলিত করল, সুদীপ্তের মৃত্যু তাঁদের নন্দনবোধে কোনও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না? বড় মর্মাহত হয়েছি। তৃণমূল নেতা মুকুল রায় যখন বললেন, সিপিএম-এর কালচার আমাদের না, তখন মাথাটা হেঁট করে রইলাম মনের মধ্যে সলিল চৌধুরী, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, তাপস সেন, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ সার দিয়ে ‘ক্লোজআপ শট’ দিয়ে গেলেন।
মনে পড়ে আশি বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ: ‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে ভারত সাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে? কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে?’ |