প্রবন্ধ ৩...
‘হাতুড়ে’ বলে তুচ্ছ না করলেই লাভ
মান্দারপুরের মঙ্গল হাঁসদা। স্বাস্থ্যের প্রয়োজন মেটে কীসে, প্রশ্ন করায় ঝাড়খন্ডের কোল-ঘেঁষা বীরভূমের আদিবাসী পল্লির ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনো করা যুবকের জবাব, ‘ওনারা মাঝেমধ্যে আসেন, দাওয়ায় বসেন, ভালমন্দ খোঁজ নেন, বাচ্চাদের টিকা দেন, গর্ভবতী মায়েদের হাসপাতালে যাবার পরামর্শ দেন। ওনারা তো সরকারি চাকরি করেন, তাই আমাদের জোর নাই ওঁদের উপর। আমাদের ভরসা ‘এনারা’ বিপদে-আপদে, রাত-বিরেতে। দু’পয়সা নেন, তবুও তো কাছে পাই।’ মঙ্গল হাঁসদার এই ‘এনারা’ সরকারি ভাবে অদৃশ্য নথির বাইরে থাকা এক প্রজাতি। এঁদের খোঁজ মেলে গ্রামের পাড়ায়, আর মাঝেমধ্যে খবরের কাগজের পাতায়। নাগরিক, উন্নত সভ্যতা নাক উঁচু করে এঁদের ‘হাতুড়ে’ নামে ডাকে, এঁদের সদা বিনাশ কামনা করে। অন্য দিকে, এঁরাই গ্রামে ঘোরেন ‘ডাক্তার’ নাম নিয়ে, সদর্পে। তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতনের ‘জীবন মশাই’-এর পরবর্তী প্রজন্মের ‘এনারা’ মূলত বেসরকারি গ্রামীণ চিকিৎসার বাজারে ওষুধের ক্ষুদ্র ব্যাপারি, নিতান্তই ‘কিছু না থাকা’ গ্রামে কিঞ্চিৎ বুদ্ধি ব্যয় করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এঁদের প্রতি স্বাস্থ্যকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন ভাসুর ঠাকুরের মতো। ‘জানি ওনারা আছেন, কিন্তু ওঁদের নিয়ে কথা বলা, বাঞ্ছনীয় নয়। বড়ই স্পর্শকাতর বিষয়টা।’
বাস্তব। মেয়াদা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ২০১০। ছবি: সুমন বল্লভ
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কে ‘ঘরের লোক’ আর কে-ই বা ‘পরের’, তা ঠিক করায় মঙ্গল হাঁসদার প্রায় কোনও ভূমিকাই নেই। নির্মাণ ভবনের পাঠানো কর্মীরা গ্রামে সমীহ পান, দাওয়ায় বসার জায়গাও জোটে। জোটে না হৃদয়ে আর মস্তিষ্কে ঢোকার অধিকার। যেটা পান গাঁয়ের ‘ডাক্তার’। বহুধাবিভক্ত গ্রামের এই স্বাস্থ্য সংস্কৃতিতে ভাবা দরকার কী ভাবে এই প্রাচীর ডিঙোনো যায়, একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠেন। মঙ্গল হাঁসদার কথা আর নির্মাণ ভবনের দৃষ্টি ও অগ্রাধিকারের মেলবন্ধন জরুরি।
আরোগ্য নিকেতনের রঙ্গলাল ডাক্তারের থেকে হালফিলের পাথরপ্রতিমার পলাশ বা আরশার যুধিষ্ঠির মাহাতো। চিকিৎসাবিদ্যা থেকে বিজ্ঞানে যত পাল্টেছে, এঁরাও নিজেদের কাজের পদ্ধতি, প্রকরণ পাল্টেছেন। নিদান হাঁকা আর কবিরাজি ছেড়ে এঁরা আধুনিক অত্যাধুনিক অ্যান্টিবায়োটিক ধরেছেন, সবটাই দেখে শিখে। জ্বর-জ্বালা, সর্দিকাশি, কাটাছেঁড়া থেকে ছোটখাটো অপারেশন, সবই এঁরা করে থাকেন। গ্রামের গরিব মানুষই মূলত এঁদের ‘খদ্দের’, যদিও রাতের বেলায় সম্পন্ন ব্যক্তিও এঁদেরকেই পান প্রয়োজনে, আর তাতেই এঁদের সামাজিক মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। চিকিৎসকের চেম্বারে বা ওষুধের দোকানে কাজ করতে করতে একটা সময় ওষুধ দেওয়ার কাজে যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠেছেন মনে করেন এঁরা এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। গ্রামীণ চিকিৎসার বাজারে ‘ওষুধ’ এবং ‘বিদ্যা’ এই দুই পণ্যের উপর ভরসা করে এনারা জীবিকা নির্বাহ করেন। চিকিৎসা যেহেতু গুণগত ভাবে একমুখী বিদ্যা, সে জন্য কার কাছ থেকে পরিষেবা নেব তা ঠিক করার কাজে ‘বিশ্বাস’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। আর অশিক্ষা, দারিদ্র, অদৃষ্টবাদী চিন্তায় প্রভাবিত গ্রাম-ভারতে চিকিৎসা সংস্কৃতির অন্যতম ভূষণ হচ্ছে এই বিশ্বাস। এক বার বিশ্বাস তৈরি করতে পারলে পেশা বেঁচে থাকে যুগ যুগ। অন্য দিকে, এই পথ দিয়েই আবার তৈরি হয় ‘যা-খুশি করা’র প্রবণতা। অসুস্থ মানুষের অসহায়ত্ব আর ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণহীতা, দুইয়ের বেড়াজালে মাঝেমধেই এমন অনেক কীর্তি এনারা করেন, যা চরম ক্ষতিকারক। দেশের আইনেও এই কুল অস্বীকৃত। ফলে এঁদের ক্ষতিকার দিকটাই বার বার আলোয় আসে। যখন এবং যেখানে প্রাণ বাঁচানোর কেউ নেই, তখন খড়কুটো হয়ে এঁরাই যে গ্রামভারতের কোটি মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা হয়ে থাকেন, এই বাস্তবতা সামাজিক বিচার ও আইনের আঘাতে পর্যুদস্ত হয়। পরিকল্পক আর গবেষকদের দ্বিধাটাও সে কারণে।
যিনি ওষুধ দিয়ে রোগ সারান, আমাদের দেশে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের সাধারণ ধারণায় তিনিই চিকিৎসক হয়ে ওঠেন, তা তাঁর প্রয়োজনীয় পড়াশুনা বা প্রশিক্ষণ থাক বা না-থাক। তা ছাড়া ‘ডাক্তার’ উপাধি ধারণে ক্ষমতায়নের গন্ধ থাকে। অনিয়ন্ত্রিত এই স্বাস্থ্যকর্মীরা তাই ‘ডাক্তার’ তকমা ধারণ করে আত্মপ্রসাদ পান, সমীহ বাড়ান গ্রামে। নিজেকে ক্ষমতাশালী হিসেবে জাহির করে জীবিকা নির্বাহের এই পদ্ধতিতে যেহেতু অসততা ও প্রতারণার ব্যঞ্জনা মিশ্রিত থাকে, তাই এঁদের নিজের প্রতি শ্রদ্ধার জায়গাটাও দুর্বল হয়ে পড়ে। এঁদের মূল শক্তি গ্রামের মানুষের সঙ্গে নৈকট্য এবং আত্মীয়তা, তাই এঁদের দুর্বলতার জায়গাগুলো ভরাট করার কথাটা ভাবা যেতে পারে কি?
গ্রামীণ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার আঙিনাটা অত্যন্ত প্রশস্ত, তাতে ভরাট করার মতো জায়গাও অনেক। মূল প্রবাহের আলোকপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের কাজ করুন না, এঁরা পাশে থাকতেই পারেন নতুন ধারার স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে। ‘চিকিৎসক’ নন, হতে পারেন গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবক, যাঁদের মুখ্য ভূমিকা ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে, কখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতেই হবে, নচেৎ বিপদ তা ঠিক করার কাজে। মরণাপন্ন গ্রামবাসীকে তাৎক্ষণিক মৃত্যু রোধ করে উন্নত চিকিৎসালয়ে পৌঁছনোর পথ যদি এঁরা দেখাতে পারেন, তা হলে মানুষের কল্যাণ হবে, বাড়বে এঁদের পেশাগত উপযোগিতাও। এ দেশে প্রতিরোধমূক কর্মসূচিতে জড়িত স্বাস্থ্যকর্মীরা মানুষের হদয়ে সব সময় পৌঁছতে পারেন না, তাতে কর্মসূচির গ্রহণযোগ্যতাও কমে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবকদের পরিখার বাইরে না-রেখে যদি ভিতরে আনা যায়, তা হলে এই কর্মসূচিগুলির সাফল্যও বাড়তে পারে।
‘ওরা হাতুড়ে’ বলে অবজ্ঞা না করে এঁদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা দরকার। গ্রামে আরও আলো ঢুকলে আমরা খুশি হব, এঁরাও। যত দিন তা আসছে না, তত দিন এঁদের একটু ব্যবস্থার কাছে টানলে ‘কী করতে হবে না’ আর ‘কী করতে হবে’ শেখালে গ্রামের মানুষেরই উপকার হবে। দুর্বল স্বাস্থ্য প্রশাসনিক বিধি, বিজ্ঞানসম্মত ভাবে মানুষের প্রয়োজন না মেটাতে পারা, অনিয়ন্ত্রিত ফাঁকফোকর দিয়ে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবকদের বিকাশ। এগুলিতে নজর দেওয়াও ভীষণ জরুরি।

ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এ শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.