হুল্লোড়
শুনতে কি চাও
নাম: গদাধর নায়ার।
বয়স: আনুমানিক ৩৫।
পেশা: টলিউডের ব্যস্ততম ফলি আর্টিস্ট।
জ অবধি কোনও সংবাদপত্র তাঁর সাক্ষাত্‌কার নেয়নি। আর সাক্ষাত্‌কার নেবে শুনলেও গদাধর যে খুব একটা খুশি হন তাও না। মঙ্গলবার দুপুরবেলায় তিনি ট্রেনে ছিলেন। কাজ সম্বন্ধে জানতে চেয়ে ফোন করাতে খানিকটা অপ্রস্তুত। গলার আওয়াজে দ্বিধা স্পষ্ট। হঠাত্‌ থানা থেকে ফোন এসেছে শুনলে কারও যেমন প্রতিক্রিয়া হবে, অনেকটাই সে রকমই প্রতিক্রিয়া গদাধরের। “হ্যাঁ জানি, ‘শব্দ’-এ কাজও করেছি। ট্রেনের খুব শব্দ হচ্ছে। কিছু শোনা যাচ্ছে না। তা ছাড়া কাজের কথা অত সহজে বলা যায় না!” বলেই ফোন রেখে দিলেন।
গদাধর ওরফে গয়া যাচ্ছেন তাঁর দেশের বাড়ি ওড়িশাতে। নিজের কেরিয়ার শুরু করেছিলেন এক বিজ্ঞাপন সংস্থা থেকে। সেখানে চা দিতেন। তার পর কাকতালীয় ভাবে কাজ শুরু করেন সাউন্ড ডিজাইনার দীপঙ্কর চাকীর সঙ্গে। “প্রথম ওকে বলি ‘পাতালঘর’ ছবিতে মিউজিকাল ফলির কাজ করতে। ওকে বলেছিলাম ছবিটা স্ক্রিনে দেখবি। আর যখন স্ক্রিনে দেখবি কাপটা কেউ টেবিলে রাখছে, তুইও সেটা করবি। ও দেখলাম তাড়াতাড়ি সব কাজ শিখে ফেলল। পায়ের শব্দটা তুলতে একটু সময় লেগেছিল। গয়ার সব থেকে ভাল কাজ ছিল ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’-এ। পুরুষ হয়েও বিপাশা বসুর হাঁটার শব্দ কী সুন্দর নকল করেছিল! এমনকী ‘খেলা’ ছবিতেও ভাল কাজ করেছিল ও। এত দিনে হয়তো একশোটারও বেশি ছবি করেছে,” দীপঙ্কর বলেন। এরই মধ্যে এক দিন দীপঙ্কর গয়াকে বলেছিলেন ‘শব্দ’-এর কাজ নিয়ে সাক্ষাত্‌কার দিতে। “ও কী লজ্জা পেয়েছিল সেটা শুনে! ‘কী যে বলেন...এখন আমার অনেক কাজ’ বলে আমারই একটা ছবির কাজ করতে ঢুকে গিয়েছিল স্টুডিয়োতে,” বললেন ‘শব্দ’র জন্য জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত দীপঙ্কর।
‘শব্দ’ ছবির দৃশ্যে সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং ঋত্বিক চক্রবর্তী
তবে সব ফলি আর্টিস্ট গয়ার মতো লাজুক নন। পঞ্চাশ বছর বয়সি মুম্বইয়ের ফলি আর্টিস্ট রাজেন্দ্র গুপ্ত। ১৯৮২ থেকে বলিউডে কাজ করছেন। প্রথম কাজ শত্রুঘ্ন সিনহার ছবিতে। বছরে তিরিশটি হিন্দি ছবি করেন। তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন তিনি। “হ্যাঁ, শুনেছি আমাদের নিয়ে একটা ছবি হয়েছে কলকাতাতে। তবে দেখা হয়ে ওঠেনি,” বলেন রাজেন্দ্র।
আর তার পর শুরু করেন নিত্য নতুন শব্দ তৈরি করার গল্প। “যখন ‘১৯৪২ আ লাভ স্টোরি’ ছবিটি তৈরি হয় আমাকে বলা হয়েছিল কাজের সময় প্যান্ট পরে থাকলে কাপড়ের আওয়াজটা মাইক্রোফোনে ধরা পড়ে। তাই আমি যেন শুধু শার্ট পরে কাজ করি। এ রকম অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আগে হয়নি। তবে আমি একটুও কুন্ঠাবোধ করিনি। আমি রাজি হয়ে যাই। যখন কাজ করি, অনেক সময় পরনে থাকে শুধু হাফ প্যান্ট বা বক্সার শটস। লজ্জা করে না। কাজের সময় আমার অন্য কোনও দিকে মন থাকে না,” বলেন রাজেন্দ্র।
গল্প করেন কী করে রামগোপাল বর্মার ‘জঙ্গল’ ছবিতে একটা ‘ব্লো’-এর আওয়াজ তৈরি করার জন্য চল্লিশ কেজি মাংস কিনেছিলেন। “মাংসটা ‘চপ’ করতে থাকি। সেই আওয়াজটাই পরে লেয়ারিং করে এমন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল যেন কেউ কাউকে সপাটে আঘাত করছে!” বলেন তিনি।
সব থেকে মজার ঘটনা ঘটেছিল ‘দেবদাস’-এ। “প্রথমে ছবির সব শব্দই তৈরি করা হয়েছিল কম্পিউটারে। এটা করা হয়েছিল যাতে ফলি আর্টিস্টকে আর প্রয়োজন না হয়। কাজ শেষ হওয়ার পরে রি-রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে দেখা যায় কী যেন একটা মিসিং। বোঝা গেল যে ‘হিউম্যান ফ্যাক্টর’টার অভাব রয়েছে। তার পর আমি কাজে লেগে পড়ি। মদ্যপ শাহরুখের পায়ের আওয়াজ থেকে ঐশ্বর্যা-মাধুরীর গয়নার সবই তৈরি করি। ‘পরিন্দা’তে তো ক্লাইম্যাক্সে নানা পটেকরের চপ্পলের আওয়াজ তৈরি করি চামড়া ঘষে। ‘১৯৪২ আ লাভ স্টোরি’তে বোমা তৈরির আওয়াজ বানাই নারকেলের দড়ি দিয়ে! ‘ব্ল্যাক’-এ রানির আঙুলের নড়াচড়ার শব্দ আমি স্টুডিয়োতেই নিজের গা ঘষে তৈরি করেছিলাম,” বলেন রাজেন্দ্র।
এই তো সোমবার কাজ করছিলেন রণবীর কপূর আর দীপিকা পাড়ুকোনের ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যে দিওয়ানি’ ছবিতে। বরফের উপর নায়ক-নায়িকা হাঁটছেন। কী ভাবে তৈরি করলেন সেটা? “নুন ছিটিয়ে দিয়ে তার উপর দিয়ে হাঁটলাম। তবে এ ছাড়াও আরও কিছু ছিল যা বলা যাবে না।” এত দিন কাজ করেও ট্রেড সিক্রেট রাজেন্দ্র বলতে নারাজ।
চেন্নাইয়ে থাকেন সি সেথু। সেই ১৯৮০ থেকে ফলি আর্টিস্টের কাজ করছেন। মণিরত্নম, ফারহান আখতার, প্রিয়দর্শন, রামগোপাল বর্মা সবার সঙ্গে কাজ করেছেন। “রজনীকান্তের সব ছবিতেই কাজ করেছি আমি। মণিরত্নমের ‘রাবণ’-এ ব্রিজ ভাঙার দৃশ্য রয়েছে। অনেক নতুন জিনিস তৈরি করেছিলাম ওটার জন্য। মিনারেল ওয়াটারের বোতল দুমড়ে আওয়াজ বের করেছিলাম। মনে আছে ‘রোজা’তে সেই জওয়ানদের পায়ের শব্দ? উইসেলের শব্দটা ফলো করে আমি আর আমার অ্যাসিস্ট্যান্টরা স্টুডিয়োতে হাঁটতে থাকি,” সেথু বলেন।
সেথু এখনও খবর পাননি যে কলকাতাতে তাঁর মতো এক ফলি আর্টিস্টকে নিয়েই ছবি হয়েছে। “আমাদের নিয়েও এ দেশে কেউ ছবি করেছে?” আশ্চর্য হয়ে বলেন তিনি।
কম্পিউটারের যুগে কি ফলি আর্টিস্টদের জায়গাটা কমে আসছে? মুম্বইয়ের সাউন্ড ডিজাইনার অনুপ দেব তা মানতে নারাজ। ‘‘ছবিতে ফলি আর্টিস্টদের একটা বড় জায়গা ছিল আশি আর নব্বইয়ের দশকে। এখনও রয়েছে। ‘কৃশ’ করার সময় মনে আছে হৃতিকের সেই কোটের এক অদ্ভুত শব্দ। ফলি আর্টিস্ট ওটা স্টুডিয়োতে তৈরি করেছিল। যখন কৃশ উড়ত, ওর কোটের একটা অদ্ভুত শব্দ হত। স্টুডিয়োতে ফলি আর্টিস্ট কোটের কাপড়টাকে উড়িয়ে উড়িয়ে ফতফত করে আওয়াজটা তৈরি করত। এখনকার যা টেকনোলজি এসেছে তাতে অনেক স্টক সাউন্ডই পাওয়া যায়। সেটা ব্যবহার করা হয় ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে ফলি আর্টিস্টের কাজটা একটা লেয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়,” বলেন অনুপ।
কখনও শব্দ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আওয়াজের প্রতি অবসেশন তৈরি হয় কি এই শিল্পীদের? ঠিক যে ভাবে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবিতে দেখানো হয়েছে? রাজেন্দ্র বলেন, “দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেকটা শব্দ কী ভাবে স্টুডিয়োতে তৈরি করা যায় সেটা আমাকে ভাবায় ঠিকই। তবে স্টুডিয়োর বাইরে আমি ঘোর সংসারী। আওয়াজ নিয়ে কোনও পাগলামি নেই।”
তবে ফলি আর্টিস্টদের অনেক সময় অভিমান হয় তাঁদের কম পারিশ্রমিক নিয়ে। “টলিউডে একটা ছবি করতে প্রায় পনেরো দিন লাগে। সারা রাত ধরে কাজ করেন তাঁরা। ছবির বাজেট হয়তো দু’কোটি টাকা। কিন্তু এক জন ফলি আর্টিস্ট হয়তো পান পনেরো হাজার মাত্র। তাই গয়া তো জীবনবিমার এজেন্ট হিসেবেও কাজ করে,” বলেন ‘শব্দ’র পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।
আর একটা ক্ষোভ। আর তা হল দর্শকের ছবি ভাল লাগলেও তাঁদের নাম কেউ জানতেও পারেন না। এমনকী ইন্ডাস্ট্রির লোকেরাও হয়তো তাঁদের চেনেনও না। ফলি আর্টিস্টদের জন্য কোনও জাতীয় পুরস্কার হয় না। রাজেন্দ্র অবশ্য বলছেন যে পরিচালক তাঁর কাজ নিয়ে খুশি হলেই তাঁর আনন্দ।
‘শব্দ’-র আওয়াজ
কীসের আওয়াজ কী ভাবে হয়
ব্রিফকেস-এর ক্লিপ খোলা বন্ধ করে
বাটিতে জল নিয়ে তার মধ্যে হাত দিয়ে থাবড়ে থাবড়ে
মোটা ড্রামস্টিক ঠুকে
আখে কামড় দিয়ে
মাইকের স্ট্যান্ড ঠুকে
চাবির থোকা এক হাত থেকে অন্য হাতে নিয়ে
পেতলের পিচকিরি দিয়ে
জিনস্‌-এর উপর নখ দিয়ে আঁচড়ে
কিন্তু গয়া?
“শুনেছি অনেক অভিমান জমে আছে। আমার ছবিতে তারকের (ঋত্বিক চক্রবর্তী) চরিত্রের মতোই, তাঁরও একটাই অভিমান। ঋত্বিকের মতোই হয়তো গয়াও ভাবে: ‘শুধু মিঠুন, প্রসেনজিত্‌, দেব করলেই হবে? ওঁদের আওয়াজগুলো কে করছে? ঘুসি, লাথি? তারক... শালা রাষ্ট্রপতি আমার কাজ জানে অথচ বরানগরের লোক জানে না তারক কে!’’’ কৌশিক বলেন।‘শব্দ’র টাইটেল কার্ডে প্রধান চরিত্রদের সঙ্গে তাঁর নাম রয়েছে। তবে লাজুক গয়ার অভিমান বোধহয় কমেনি। শেষ পর্যন্ত ফোনটা ধরেননি তিনি। এত দিন গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অনীক দত্তের ছবি করেও কেউ সাক্ষাত্‌কার চায়নি। ‘শব্দ’র পর তাঁর নিস্তব্ধতা হয়তো সেই অভিমানেরই প্রতীক।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.