বাবা জ্ঞান দিয়ো না
জীবন মরণের সীমানা ছাড়ানোর পাসওয়ার্ড
দেখতে দেখতে তিন তিনটে বছর কেটে গেছে।
আর এক মাসের মধ্যেই মুক্তি পাবে প্রয়াত পরিচালক রাজ বসুর ‘পিয়ালির পাসওয়ার্ড’। মুখ্য ভূমিকায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী আর কৌশিক সেন।
রাজ বসু
রাজের শেষ স্বপ্নটা পূরণ হতে মাত্র কয়েক সপ্তাহের অপেক্ষা। তবে আমেরিকার সুদূর ভার্জিনিয়াতে বসে এই অপেক্ষার দিনগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে আসছে রাজের স্ত্রী শুচিস্মিতা বসুর কাছে। স্মৃতি হাতড়ে নানা মুহূর্ত ভেসে উঠছে। আর তার সঙ্গে গ্রাস করছে শূন্যতা।
অবশেষে আমেরিকাতে শু্যটিং করা টলিউডের প্রথম ছবি দেখবে কলকাতা। সবাই আছে। শুধু রাজ নেই।
“মনে পড়ে রাজের শেষ দিনগুলোর কথা। ও কোমাতে চলে গিয়েছে। কথা নেই। আমি কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে বলেছিলাম, ‘রাজু, রোজভ্যালির সঙ্গে হয়তো পিয়ালির পাসওয়ার্ড ছবিটা রিলিজ করার চুক্তিটা সই হবে।’ কথা বলতে পারেনি। তবে ওর ব্রেনটা কাজ করছিল। ও ঠিক বুঝতে পেরেছিল। আস্তে আস্তে শুধু মাথাটা নেড়েছিল কথাটা শুনে,” ধরা গলায় বলেন শুচিস্মিতা বসু।
২০১০-এর ২৮ জানুয়ারি রাজ চলে যান। রেখে যান স্ত্রী ও টিনএজার দুই ছেলেমেয়েকে।
আজ বেদনামিশ্রিত আনন্দে ছেয়ে গিয়েছে শুচিস্মিতার মন। আপন জনের কাছে তিনি মিতা বলেই পরিচিত। রাজ চলে যাওয়ার পর জীবনটাই কেমন পাল্টে গিয়েছে তাঁর। অফিসের ব্যস্ততার জীবন এক দিক থেকে আশীর্বাদ। নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই। তার মধ্যে একটু ফাঁক পেলেই স্মৃতিরা ভিড় জমায়।
যাঁর কাছে রাজকে নিয়ে পার্টিতে যাওয়া মানেই ছিল হুল্লোড়ে মেতে ওঠা, সেই শুচিস্মিতা আজ একেবারেই বিচ্ছিন্ন। “কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। ওকে এত মিস করি এই অনুষ্ঠানগুলোতে,” বলেন তিনি।
এমনকী রান্নাঘরে ঢুকতেও ইচ্ছা করে না মাঝে মাঝে। “ও এত ভাল রান্না করত। আমি তো ওর কাছেই রান্না করা শিখেছিলাম। দেব আনন্দের ছবি ছিল ওর খুব প্রিয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতও খুব পছন্দ করত। ওর সব থেকে প্রিয় গান ছিল ‘দূরে কোথাও দূরে দূরে’। বিক্রম ঘোষ যখন এই ছবিতে মিউজিক করলেন, তখন রাজের ওই প্রিয় গানটাও ব্যবহার করা হয়েছিল,” বলেন শুচিস্মিতা।
খানিক ক্ষণ নিস্তব্ধতা।
তার পর বলেন ২০০৯-এর সেই অভিশপ্ত দিনটির কথা।
যে দিন প্রথম চোখের সামনে দেখলেন যে তার স্বামীর শরীরটা অকস্মাৎ কেমন বেগুনি হয়ে যাচ্ছে। সারা শরীরের চামড়া অদ্ভুত ভাবে ফেটে ফেটে গিয়েছে। গলা, ঘাড়, চিবুক, পা... সব জায়গাতে অ্যালার্জি।
‘পিয়ালির পাসওয়ার্ড’ ছবির দৃশ্যে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং সব্যসাচী চক্রবর্তী।
কিন্তু তাই বলে এমন কী অ্যালার্জি, যার কোনও চিকিৎসা হবে না? সেটাও কী সম্ভব নাকি?
মানতেই পারেননি কেউ সেই কথা। প্রথমে ‘আরাভা’ বলে একটা ওষুধ থেকে প্রচণ্ড ড্রাগ অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হয়েছিল রাজের। দিন পনেরো পরে সারা গায়ে র্যাশ। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে স্টেরয়েড দেওয়া শুরু হয়। ধীরে ধীরে খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ। কথা বলতে গেলেও খুব কষ্ট হত। এমনকী চোখের পাতাও কুঁকড়ে গিয়েছিল।
আমেরিকার ডাক্তাররা তত দিনে জানিয়ে দিয়েছেন যে রাজের অবস্থা খুবই সিরিয়াস। ‘স্টিভেন জনসন সিন্ড্রোম’ নামে এক কঠিন ব্যাধি তাঁর গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়েছে।
সারা বিশ্বে দশ লক্ষ মানুষের মধ্যে হয়তো এক জনের এই অসুখটি হয়। আর এই রকম এক রুগির নাম ছিল রাজ বসু।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটা সে দিনও মনে এসেছিল রাজের। বা তার ঘনিষ্ঠ মানুষদের মনে।
হোয়াই ডিড ইট হ্যাভ টু বি রাজ?
এত মানুষের মাঝে রাজেরই এই রোগটা হতে গেল কেন? ও তো কারও কোনও ক্ষতি করেনি...
সেই এক প্রশ্ন যা যে কোনও টার্মিনাল রুগির ক্ষেত্রেই সবাই করে থাকেন। ওকে কেন এত কষ্ট পেতে হচ্ছে?
“প্রথম দিকে যখন শুনেছিল নিজের রোগের কথা, তখনও রাজের বিশ্বাস ছিল যে হি উড সারভাইভ। এত অল্প বয়সে আমাদের এ ভাবে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই পারেনি। আমাদের মেয়ের বয়স তখন উনিশ। ছেলের পনেরো। মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে। ছেলেও ভাল করছে। কেউ আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না যে রাজ নেই। মনে হয় হয়তো আবার ফিরে এসে বলবে, ‘অ্যাকশন’। রাজ, হাসপাতালে থাকাকালীন আমি ওকে বলেছিলাম যে ডাক্তার ভুল ওষুধ দিয়েছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে কেস করব। রাজ অবশ্য বলত, আমি ওদের সঙ্গে পেরে উঠব না,” বলেন শুচিস্মিতা।
রাজ চলে যাওয়ার পরে শুচিস্মিতা কেস করেননি। কারণ? মানুষটাই নেই। টাকাপয়সা দিয়ে তো আর তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না।
রূপা গঙ্গোপাধ্যায়
সাউথ পয়েন্টের কৃতী ছাত্র ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার পণ্ডিতিয়া এলাকার রাজ। তার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চলে যান আমেরিকায়।
পেশায় দারুণ উন্নতি করলেও, কোনও দিন সিনেমার প্রেম ভুলতে পারেননি। আমেরিকাতে বসে সিনেমা নিয়ে চর্চা করেছেন। ছবি দেখতেন নিয়মিত। প্রথম ছবিটা বানিয়েছিলেন ইংরাজিতে। তার পরেরটি বাংলায়। ‘পিয়ালির পাসওয়ার্ড’। সাসপেন্স থ্রিলার। আমেরিকাতে একটি মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চিত্রনাট্যটি লিখেছিলেন রাজ।
ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া সুনন্দা চন্দ আজও বুঝতে পারেননি, ছবিটি মুক্তি পেলে কী অনুভূতি হওয়াটা ঠিক। “যাঁরা রাজুদাকে চিনতেন, তাঁরা সবাই জানেন, কী অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিল ও এই ছবিটার জন্য। মানুষ হিসেবে রাজুদা ছিল খুব প্রাণবন্ত। যাকে বলে হার্ট অফ দ্য পার্টি। কোথাও গেলেই মিনিটের মধ্যে রাজুদা একেবারে জমিয়ে দিতেন আড্ডাটা। আজ ভাবি, মাত্র ছ’মাসের মধ্যে কী ভাবে রাজুদার চেহারাটা বিকৃত হয়ে গেল! শরীরটা যেন হাসপাতালের বেডের সঙ্গে একেবারে মিশে গিয়েছিল। মিতাদি যে কী ভাবে ওঁকে শেষের দিকে খাইয়ে দিত, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না,” বলেন সুনন্দা।
শেষের দিকে সাঙঘাতিক ডায়েরিয়া হয়ে গেল। “তখনও রাজুদা হাসপাতালে যেতে চাননি। কিন্তু এত ডিহাইড্রেশনের পর নার্সিং হোম ছাড়া আর উপায় ছিল না। অ্যাম্বুল্যান্সে যাওয়ার সময় রাজুদা মিতাদিকে বলেছিল: “মিতা, আমাকে নার্সিং হোমে নিয়ে যেও না। আমি তা হলে আর ফিরব না।” মিতাদি উত্তরে বলেছিল, “তোমাকে ফিরিয়ে আনার জন্যই তো নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, রাজু।” চার মাস নার্সিং হোম আর রিহ্যাবে ছিল। কিন্তু বাড়ি আর ফেরা হল না। শেষে নিউমোনিয়া হয়ে গেল। ভেন্টিলেটরে ছিল...” বলতে বলতে সুনন্দার কথা আটকে যায়।
আর তার পরই বলেন ভাগ্যের এক অদ্ভুত পরিহাসের কথা। রাজের চিত্রনাট্যের সঙ্গে একটা সাঙঘাতিক মিল রয়েছে তাঁর নিজের জীবনের। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের চরিত্র আমেরিকার একটি ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে এসে দেখেন যে ওখানে যে ড্রাগটা দেওয়া হচ্ছে, তা থেকে প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার হওয়া সম্ভব। এই ড্রাগের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করেন তিনি। আর তার পর রূপার অকস্মাৎ মৃত্যু! রূপার বোনের চরিত্রটি করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। তিনি আমেরিকাতে এসে জানতে পারেন যে তাঁর দিদির মৃত্যুটি স্বাভাবিক ছিল না। রাজুদাও তো ড্রাগের সাইড এফেক্টেই মারা গেলেন। “রাজুদার শাশুড়ি এখন মিতাদির কাছে আমেরিকাতে। এই সবের মধ্যে এখন ওঁর প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তবে এ সবের মধ্যে বলব ঋতুদির কথা। আমাদের পরিবারের তরফ থেকে কী ভাবে ওঁকে ধন্যবাদ জানাব তা জানা নেই। অনেকেই ছবি করেন। তবে ক’জন মানবিকতার কারণে এ ভাবে শেষ পর্যন্ত লেগে থেকে ছবিটিকে রিলিজ করান? রাজুদার পরের ছবিটির চিত্রনাট্য পড়ে রয়েছে। ঋতু সেটিতেও কাজ করতে চেয়েছে,” বলেন সুনন্দা।
ভারাক্রান্ত মনে ঋতুপর্ণা জানান, “আমি যখনই এই রিল আর রিয়েলের কো-ইনসিডেন্সটা নিয়ে ভাবি, তখন কেমন একটা অদ্ভুত লাগে! আর তার পর মনে পড়ে রাজের শেষ কথাগুলো: “ঋতু, দেখো যেন এই ছবিটা ঠিক মতো মুক্তি পায়।’’ আমি রাজকে কথা দিয়েছিলাম যে ছবিটার মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি চেষ্টা করবই। ‘ইচ্ছে’-এর ক্ষেত্রেও আমি সেই চেষ্টাটাই করেছিলাম। এখনও তাই করছি।”
ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে। হয়তো শু্যটিং হওয়ার বেশ কিছু বছর পর। তাতে ভয় নেই। ‘ইচ্ছে’, ‘তিন ইয়ারি কথা’, ‘পান সিংহ তোমর’ আর ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এরও মুক্তি পেতে দেরি হয়েছিল। দীর্ঘদিনের প্রসবযন্ত্রণার পরেও দর্শকের ছবিগুলো ভাল লেগেছে। রাজ চলে গিয়েছেন তিন বছর হল।
মনে পড়ে “ট্যুইসডেজ উইথ মরি’ বইটির সেই বিখ্যাত লাইন: ‘ডেথ এন্ডস আ লাইফ, নট আ রিলেশনশিপ।’
‘পিয়ালির পাসওয়ার্ড’-এর মুক্তি পাওয়াটা আবার সে কথাটা মনে করিয়ে দিল। মৃত্যু মানুষকে গ্রাস করতে পারে। তবে ভালবাসার সম্পর্কগুলো থেকে যায়...হয়তো বা আরও গভীর ভাবে বেঁচে ওঠে ধীরে ধীরে...জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে...



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.