পুরনো স্ত্রীকে বাতিল করতে চান? খুব সহজ। ‘তালাক’ লিখে এসএমএস করে দিন।
গল্প নয়। মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া ব্লকে নসিপুর গ্রামে দিব্যি ঘর-সংসার করছিলেন হাসিনা খাতুন। তাঁর কাঠমিস্ত্রি স্বামী এখানে-সেখানে কাজে যান। মাঝে-সাঝে মোবাইলে ফোন করেন, টুকটাক এসএমএস-ও।
বছর দুই আগে হঠাৎই এক দুপুরে একটি এসএমএস এল ‘তালাক’। ব্যস! সব শুনে এলাকার মসজিদের মৌলবী বলে দিলেন, ‘তালাক’ যখন দিয়েছে, আর এক সঙ্গে থাকা তো যাবেই না, স্বামীর মুখ দেখাও হারাম। হাসিনার কপাল পুড়ল।
শাহবাজপুরের সাবিনার ঘরে আবার এসএমএস নয়, সুদূর কাশ্মীর থেকে এসেছিল চিঠি। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার তালাক। প্রথম বার তাঁকে তালাক দেওয়া হয়েছিল পাঁচ মাসের মেয়ের অকালমৃত্যুর অপরাধে। তিরিশ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে বিয়ে, কিন্তু মেয়ে মরতেই তাঁর ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে তালাক দেয় স্বামী সাহনুর। পরে কাশ্মীর থেকে আসা আব্দুল রশিদ তাঁকে ফের বিয়ে করে লাতোরে নিজের বাড়িতে তোলে। সেখানেই এক দিন বিহারী জায়ের কাছে সাবিনা শোনেন, আব্দুল তাঁকে বিক্রি করে দেবে। সেটাই তার ব্যবসা। আট মাসের গর্ভাবস্থায় প্রায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে আসেন তিনি।
এ রকম সব দরিদ্র তালাক পাওয়া মহিলাদের কষ্ট-কথা ছড়িয়ে রয়েছে বহু গ্রামে। শরিয়ত তথা ইসলামি রীতি মেনে জীবনযাপনের পক্ষে যাঁরা নিরন্তর প্রচার চালায়, সেই জামাত-এ ইসলামি হিন্দের আমির-এ হালকা (সভাপতি) মহম্মদ নুরউদ্দিন বলেন, “এক সঙ্গে তিন বার তালাক শব্দ উচ্চারণ করলেই বিবাহ-বিচ্ছেদ হয় না। তালাক সাধারণত তিন মাসের প্রক্রিয়া। প্রথম তালাক বলার পরে স্ত্রী তিন মাস স্বামীর ঘরে থাকতে পারেন। এই সময়ের মধ্যে স্বামী তালাক ফিরিয়ে নিতে পারেন অথবা আরও দু’বার তালাক বলতে পারেন।”
কিন্তু সে সব মানছে কে? বাধ্য হয়ে কোণঠাসা মেয়েদের একটা বড় অংশ এখন আইনি রক্ষাকবচ চাইছেন। রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি নামে একটি সংগঠন গড়ে সরকারের কাছে বঞ্চনার কথা তুলে ধরতে চাইছেন তাঁরা। সমিতির কর্ণধার খাদিজা বানু বলেন, “শরিয়ত তালাকের যে বিধান দিয়েছে তাতে স্ত্রী-সন্তানদের কিছু অধিকারের প্রশ্নও জড়িয়ে থাকে। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে অশিক্ষিত ক্ষমতাবান মোল্লা-মোড়লদের সিদ্ধান্তই শরিয়ত। সকলের জন্য আদালতের মাধ্যমে বিবাহ-বিচ্ছেদ হোক। নিষিদ্ধ করা হোক বহুবিবাহও।”
কিন্তু তার জন্য তাঁদের এখনও আরও কতটা পথ পেরোতে হবে? পুরনো সমস্যার সঙ্গে মুসলিম সমাজে দেখা দিচ্ছে নতুন ফ্যাসাদ, কন্যাপণ। জলঙ্গীর কলিকাহারা গ্রামের আর এক সাবিনার বিয়ে হয়েছিল মুদি দোকানি সালামের সঙ্গে। পোলিওয় আক্রান্ত বাঁ পা খুঁড়িয়ে চলায় যৌতুকে এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা আর দু’ভরি সোনা দিতে হয়েছিল তাঁদের। সে সব আত্মসাৎ করে সাবিনাকে তালাক দেয় সালাম। সাবিনা এখন লেখাপড়া শিখে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছে সে।
সকলের সেই সুযোগ থাকে না। বহরমপুরের কাছে নওদাপাড়ায় আবিদা বেগমকে যখন তালাক দেওয়া হয়, তখন তাঁর বয়স বাহান্ন। ছেলে-বউ, নাতি-নাতনি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হল আবিদাকে। অন্য ঠাঁইয়ে তিনি একাই কাটাচ্ছেন। বাপের বাড়ি ঠাঁই হয়েছে অজস্র তরুণীর। যেমন ডোমকলের বেনেখালির সোনাভান। সাড়ে চার বছরের ছেলে কোলে ঠাঁই নিয়েছেন বাপের বাড়িতে।
বহরমপুরের বিশিষ্ট চিকিৎসক তথা স্থানীয় প্রবীণ সভার সভাপতি ডঃ আলি হাসানের কথায়, “তালাক নিয়ে যে ব্যাপক সমস্যা, সে দিকে প্রশাসন তাকায় না। তালাক পাওয়া মেয়েদের পাশে দাঁড়ান রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতির মেয়েরাই। ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে গিয়ে এই কাজ করাটা সহজ নয়।” নাট্যব্যক্তিত্ব সীমা সরকার বলেন, “প্রতি মুহূর্তে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় ওঁদের। আমরা টিকিট বিলিয়েও বহরমপুর রবীন্দ্রভবন ভরাতে পারি না। কিন্তু ওঁদের এক ডাকে হল উপচে পড়ে।”
ধর্মের নামে গেঁড়ে বসা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। তাঁর নাম নিয়ে কাজ শুরু করেছে যে সংগঠন, তার ভরসাতেই এখন ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন তালাক-পাওয়া মেয়েরা।
|