বামেদের ‘ঘরে ফেরা’-র ডাক আর তৃণমূলের প্রত্যাঘাতের হুমকির মাঝে পড়ে ফের চেনা আতঙ্কে কাঁপছে শাসন। এলাকার মাছের ভেড়ির দখল থেকে মেলা কাঁচা টাকার সূত্রেই এই অশান্তির আবহ বলে মানছে পুলিশ সূত্র।
এ দিকে, রবিবার দেগঙ্গার বেলিয়াঘাটা থেকে মজিদ মাস্টার গ্রেফতার হওয়ায় ভেড়ি সন্নিহিত এই এলাকায় ফের অশান্তি আবহ তৈরি হতে চলেছে বলে মত ওয়াকিবহাল মহলের।
উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত ২ নম্বর ব্লকের শাসনের ঘরছাড়াদের সম্প্রতি ঘরে ফেরানোর ডাক দিয়েছেন বামেরা। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা একসময় শাসনের ‘ত্রাস’ মজিদ মাস্টার (বছর দু’য়েক ঘরছাড়া) যাঁদের অন্যতম। পঞ্চায়েত ভোটের আগে সেই ঘরছাড়াদের ফেরানোর দাবিতে এখন শাসনে মিছিল-মিটিং করছে সিপিএম। সিপিএমের জেলা নেতা অমিতাভ নন্দী বলছেন, “ঘরছাড়াদের ফেরানো হবেই।” প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় পাল্টা সভা-শোভাযাত্রা করে তৃণমূল হুঙ্কার ছেড়েছে, ‘ঘরছাড়াদের ফেরানোর চেষ্টা করলে ফল ভাল হবে না’। তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক তথা রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছেন, “মজিদরা শাসনে ঢুকলে আঁশ-বঁটি নিয়ে সবাই তৈরি আছে।” |
ভূপ্রাকৃতিক ভাবে জলে ঘেরা শাসন। ডাঙা জমি কম। এলাকার মাগরি, চোলপুর, তেহাটা, কোলা, মিতপুকুর, রামেশ্বরপুর, মজলিসপুর, দেউপুকুর, কালিকাপুর, সর্দারহাটি, তেঘরিয়ার মতো গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে এলাকার শ্রীহীন চেহারা। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ ভেড়িতে খাটেন বা দিনমজুর। এমন এলাকার দখল নিতে রাজনৈতিক দলগুলিরই বা এত উৎসাহ কেন?
পুলিশ-প্রশাসন সূত্রের দাবি, ‘উৎসাহে’র পিছনে রয়েছে এলাকায় ভেড়ির দখল নেওয়া এবং রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার লোভ। মাছ উৎপাদনে রাজ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে উত্তর ২৪ পরগনা। মৎস্য দফতর সূত্রের খবর, কেবল শাসন-খড়িবাড়ি এলাকায় ৫,৬৭০ একর ভেড়িতে মাছ চাষ হয়। তার মধ্যে মাত্র ৫০০ একরের জন্য লাইসেন্স আছে। বাকি হাজার পাঁচেক একরের ভেড়ি থেকে বছরে গড়ে এক কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। অথচ, সেই অবৈধ ভেড়িগুলি বছরে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে।
ওই এলাকায় বেশিরভাগ ভেড়ি সরকারি অথবা লিজে চলছে। কিন্তু সেই ভেড়িগুলির কর্তৃত্ব পঞ্চায়েত বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। আগে এলাকা ছিল সিপিএমের দখলে। এখন বেশিটাই কব্জা করেছে তৃণমূল। ভেড়ির লাইসেন্স না থাকলে বিধি অনুযায়ী থানায় এফআইআর করার কথা মৎস্য দফতরের। কিন্তু ওই দফতর সূত্রের খবর, ভেড়ি পরিচালকদের পিছনে রাজনৈতিক মদত থাকায় থানায় অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা হত না। ২০০৪ সালের পর থেকে ওই ধরনের অভিযোগ জানানোই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেলা মৎস্য আধিকারিক (লাইসেন্স) সৌমেন ভট্টাচার্য বলেন, “কোটি টাকার রাজস্বের ক্ষতি হচ্ছে। সরকারের কাছে বহু বার অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা কিছুই হয়নি। আমাদের কী করার আছে?” জেলা পুলিশের কর্তারা অবশ্য অভিযোগ মানতে নারাজ।
অবৈধ ভেড়ি থেকে পাওয়া বিপুল টাকার লোভেই যে এলাকায় অশান্তি লেগে থাকে, কার্যত সেই ইঙ্গিত মিলেছে এলাকার সিপিএম এবং তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য। সিপিএমের জেলা পরিষদ সদস্য কুতুবউদ্দিন আহমেদের অভিযোগ, “আগে মাছ চাষ করে এলাকার চাষিরা টাকা পেতেন। এখন শাসন-খড়িবাড়ির ভেড়িগুলো থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে তৃণমূলের এক-এক জন নেতা। ওই টাকা আদায় নিয়ে ওদের নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটির জেরেই এলাকায় শান্তি চলে গিয়েছে।” পক্ষান্তরে তৃণমূলের জেলা সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার সাঁপুই বলছেন, “সিপিএমের চাপে শাসনের মানুষ এত দিন না খেয়ে ছিলেন। এখন তাঁরা খেতে পাচ্ছেন। সে জন্যই ওরা এলাকায় ঢুকতে পারছে না। তাই এত উঠে-পড়ে লেগেছে।”
২০০৮-এ পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএম শাসনের দখল রেখেছিল। কিন্তু ২০০৯-এ লোকসভা ভোটের পর থেকে এলাকার অনেকটাই চলে যায় তৃণমূলের দখলে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় গ্রামগুলি জড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক কোন্দলে। ২০১১-র বিধানসভার পরে কার্যত এলাকাছাড়া হন সিপিএমের দাপুটে নেতারা। তার পর থেকে মোটামুটি শাসনের প্রায় গোটাটাই রয়েছে তৃণমূলের শাসনে। ২০১২ কাটে শান্তিতেই। চলতি বছরে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে নড়াচড়া শুরু হতেই শাসনে ফেরার ডাক দেয় বামেরা। পাল্টা হুমকি দিয়ে আসরে নামে শাসক দলও।
ফের কি রক্তপাত অনিবার্য? জেলা পুলিশ সুপার সুগত সেন বলেন, “শাসনে পুলিশ বাড়ানো হয়েছে। দু’পক্ষকেই বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার ফের অবনতি হোক, এটা নিশ্চয় কোনও দলই চাইবে না।”
তবে একই প্রশ্ন শুনে মাছ ধরা থামিয়ে এলাকার বৃদ্ধ চাষি মহিউদ্দিন (নাম পরিবর্তিত) ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। আর চোলপুর, দেউপুকুর, সর্দারহাটির একাধিক গ্রামের বাসিন্দাদের পাল্টা প্রশ্ন, “আবার?” |