নববর্ষের সন্ধ্যা নামলেই নবদ্বীপের অতি ব্যস্ত বড়বাজারের ভিড়ে দেখা যেত এক দীর্ঘদেহী ব্রাহ্মণকে। পরনে পট্টবস্ত্র। গায়ে পাটভাঙা উত্তরীয়। তাঁর ফাঁক দিয়ে পৈতের গোছা উঁকি দিত। সঙ্গে শালগ্রাম শিলার বদলে এক বালক। যার এক হাত শক্ত করে ধরা ব্রাহ্মণের বাঁ হাতে। তিনি পণ্ডিত আশুতোষ সিদ্ধান্ত।
সে কালের নবদ্বীপের নামী মুদি ব্যবসায়ী পঞ্চানন ঘোষের দোকানে সেই ব্রাহ্মণ পৌঁছতেই হই-হই করে ছুটে যেতেন দোকান মালিক। পরনে ধোপদুরস্ত পোশাক। সোনার বোতাম চিকচিক করছে। তিনি প্রণত হয়ে বলতেন, “আসুন পণ্ডিত মশাই।” তার পর পণ্ডিতমশাইকে নিয়ে গিয়ে সরাসরি বসানো হত খোদ মালিকের গদিতে। মালিক-সহ দোকানের সকলে প্রণাম করতেন তাঁকে। পণ্ডিতমশাই আশীর্বাণী উচ্চারণ করে শুভ কামনা জানাতেন। কিছু ক্ষণ বসে উঠে পড়তেন। ছুঁয়েও দেখতেন না কোনও মিষ্টি বা সরবতের গেলাস।
ব্রাহ্মণ বলে নয়, পণ্ডিত বলে সম্মান পেতেন তিনি। পয়লা বৈশাখ ছিল মিলনোৎসব, তাতে আলাদা শ্রদ্ধার আসন পাতা থাকত বিদ্যাজীবীদের জন্য।
এ সব আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগের কথা। “আমার ছেলেবেলায় নববর্ষ এ ভাবে আসত নবদ্বীপের বাণিজ্যিক মহলে”, বলছিলেন প্রবীণ সংস্কৃতজ্ঞ শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত। ছোট বেলায় বাবা পণ্ডিত আশুতোষ সিদ্ধান্তের সঙ্গে নববর্ষের সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শুভেন্দুবাবু বলেন, সে কালে নবর্ষ আসত একটু অন্য ভাবে। ভোরে গঙ্গার স্নান করা ছিল অবশ্য কর্তব্য। তার পর ব্যবসায়ীরা হাল খাতা নিয়ে পুজোয় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সাধারণ গৃহস্থ বছরের প্রথম দিনে ভাল-মন্দ খাওয়ার জন্য বাজারে ছুটতেন আর সন্ধ্যার পর ভিড় বাড়ত বাজার তথা দোকানে দোকানে। তবে সেকালে প্যাকেটের ব্যবস্থা ছিল না। দোকানে গেলাসেই হয় সরবত বা ডাব। মনে আছে বাবা বাইরে কিছু খেতেন না। তাই বিভিন্ন দোকানে বাবার জন্য গোটা ডাব বা অন্য ফল দিত। আমি সেগুলো বয়ে আনতাম বাড়িতে।”
আপ্যায়ন আর আশীর্বাদে ভরা সেকালের নববর্ষের সঙ্গে আজকের ‘পয়লা বৈশাখ’-কে মেলাতে পারেন না নবদ্বীপের প্রবীণ সুতো ব্যবসায়ী মনতোষ সাহা। তিনি বলেন, “পঞ্চাশ-ষাট দশকে নববদ্বীপের তাঁত বা সুতোর সুসময়। প্রায় সারা রাজ্যের ব্যবসায়ীরা আসতেন এখানে। নববর্ষের দু’দিন আগে থেকে আমার বাবা প্রয়াত মনোরঞ্জন সাহা বাড়িতে মিষ্টির ভিয়েন বসাতেন। রসগোল্লা, পান্তোয়া আর সন্দেশ তৈরি হত। পয়লা বৈশাখ সকাল থেকে শুরু হত পোলাও রান্না। সারা দিন ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা আসতেন। বসিয়ে খাওয়ানো হত পোলাও এবং মিষ্টি।”
তবে সে সময় আজকের মত কেবল সন্ধ্যাবেলায় নয়, নববর্ষের খাওয়া-দাওয়া চলত সারা দিন ও রাত। শেষ হতে হতে মাঝ রাত। মনতোষবাবু বলেন, “তখন এত দোকানও ছিল না। তবে ব্যবসায়ীরা আসতেন কল্যাণী, ব্যারাকপুর, রানাঘাট, চাকদহ, বর্ধমান থেকেও। পয়লা বৈশাখে না এলে রীতিমত রাগারাগি হত। কারণ সেই দিনটাই তো দেখাশোনা করার দিন। খুব আন্তরিকতায় ভরা ছিল। এখন সব জায়গায় হাট তৈরি হয়েছে। ব্যবসা কেন্দ্রীভূত থাকেনি নবদ্বীপে। ফলে এখন ব্যবসায়ীদের উৎসব ঝাপসা ছবির মত মনে হয়।”
শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, নববর্ষের সন্ধ্যায় বেশির ভাগ মানুষের একটা অবশ্য পালনীয় কাজ ছিল সন্ধ্যায় নবদ্বীপের বিভিন্ন মন্দিরে গিয়ে বিগ্রহ দর্শন। বিশেষ করে মহাপ্রভুকে প্রণাম করা। শিক্ষক রেবতীমোহন সরকার বলেন, “তখন নববর্ষের দিনে বাইরে খাওয়া-দাওয়ার এত রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু বছরের প্রথম দিনে আমি বাড়ির সবাইকে নিয়ে গৌর দর্শন করার খুব রেওয়াজ ছিল। এখন অবশ্য তেমনটা নেই।”
তবে বিখ্যাত কীর্তনীয়া সরস্বতী দাস বলেন, “বছরের প্রথম দিনে আমি এখনও নিয়ম করে মহাপ্রভুকে কীর্তন শোনাই। শ্রীবাসঅঙ্গন ঘাটে স্নান সেরে সোনার গৌর দর্শন করতে সোজা মহাপ্রভুর বাড়ি।” মহপ্রভু মন্দিরের নাটমন্দিরে তখন জমাট প্রভাত কীর্তনের আসর। সেখানে সরস্বতী দাস গেয়ে ওঠেন বেলোয়ার রাগে বাঁধা মহাজনী পদ ‘কিয়ে হাম পেখলু কনক পুতলিয়া/ শচীর আঙিনায় নাচে ধূলি ধূসরিয়া...।’
রবিবার অবশ্য গোটা দিন নবদ্বীপ মেতে রইল চড়ক নিয়ে। বুড়োশিবতলা, পোড়াঘাট, গাজন তলার চড়কের বঁড়শি ফোঁড়া সন্ন্যাসী দেখতে প্রখর রোদেও উপচে পড়া ভিড়। এদিন ছিল চৈত্র সেলের শেষ প্রহর। রাধাবাজার, পোড়ামাতলা, বড়বাজার রোডে শনিবার আর রবিবার জমাট ভিড় চোখে পড়লেও খুশি নন বিক্রেতারা। চৈত্রের শেষ কটা দিন সেলকে সম্বলকে যে সব মরসুমি ব্যবসায়ীরা কিছু উপার্জন করতেনতাঁরাও হতাশ। আগামী বার তাঁরা অনেকেই সেই সেলের ব্যবসা করবেন না বলেই জানান। এদিন পুলিশ প্রশাসন প্রস্তুতি নিয়েছে পয়লা বৈশাখের সকালে নবদ্বীপের বিভিন্ন ঘাটে স্নান করতে আসা স্থানীয় এবং বহিরাগত দের ভিড় ঠেকানোর ব্যাপারে। গত তিন-চার বছর ধরে সকালে গাড়ি নিয়ে নবদ্বীপে স্নান করতে আসার হুজুগ ক্রমশ বাড়ছে। তাই সতর্কতা।
|