জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
বেকার ভাতার টাকা জোগাড়ে বৃত্তি করের ক্ষেত্রে এককালীন ওয়েভার স্কিম চালু করছে রাজ্য।
যে সব সংস্থা বা ব্যক্তি বছরের পর বছর বৃত্তি কর দেয়নি, তারা দু’বছরের করের টাকা এক বারে মিটিয়ে দিলেই অর্থ দফতর তাদের কসুর মাপ করে দেবে। তবে এক বার ওয়েভার স্কিমের সুযোগ নিলে তার পর থেকে নিয়ম করে ওই সব সংস্থাকে ফি বছর বৃত্তি কর মেটাতে হবে। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের এই উদ্যোগ সফল হলে বেকার ভাতা মেটাতে যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন, তা এখান থেকেই উঠে আসতে পারে। যা কার্যত মাছের তেলে মাছ ভাজারই সামিল বলে মনে করছেন অর্থ দফতরের কর্তারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, বাজেটে অর্থমন্ত্রী ১ লক্ষ বেকারকে মাসিক ১৫০০ টাকা করে বেকার ভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তার জন্য সব মিলিয়ে খরচ হতে পারে ১৫ কোটি টাকা। বৃত্তি করের ওয়েভার স্কিম থেকে এই টাকা তোলার পরেও রাজকোষে আরও কয়েক কোটি টাকা থেকে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন তাঁরা।
সরকারি সূত্রের খবর: ১৯৭৯ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্যাক্স অন প্রফেশনস, ট্রেডস, কলিংস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্টস অ্যাক্ট চালু করেছিল। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, চাকুরেদের কাছ থেকে বৃত্তি কর আদায় করে তা দিয়ে বেকার ভাতা দেওয়া। প্রথম দিকে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত বেকারদের মাসিক ভাতা দেওয়াও শুরু করেছিল বাম সরকার। পরবর্তী কালে বেকার ভাতা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও বৃত্তি কর আদায় চালু রয়েছে। গত বছরও প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বৃত্তি কর খাতে আদায় হয়েছে।
এ বারে বাজেটে অর্থমন্ত্রী এক লক্ষ বেকারকে ভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করার পরে প্রশ্ন উঠল, যখন ভাঁড়ে মা ভবানী হাল সরকারের, তখন এই টাকা আসবে কোথা থেকে? অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “বৃত্তি কর থেকেই এই ভাতা দেওয়ার কথা আইনে বলা রয়েছে। এত দিন করের টাকা তোলা হতো, কিন্তু ভাতা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই টাকা অন্য খাতে খরচ হোত। এখন অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পরে ঠিক হয়, ওয়েভার স্কিম চালু করে ওই বাড়তি টাকা তোলা হবে। সে জন্য পুরনো আইনে সংশোধনীও আনা হয়েছে।”
বাজেটে কী বলেছেন অর্থমন্ত্রী? তিনি জানান, নতুন সরকার যে এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক ঘোষণা করেছে, সেখান থেকে এক লক্ষ বেকারকে মাসে ১৫০০ টাকা ভাতা দেওয়া হবে। এই ঘোষণার আগে পর্যন্ত এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে মাত্র কয়েক হাজার বেকার নাম লিখিয়েছিলেন। ঘোষণার পর কয়েক দিনে প্রায় ১২ লক্ষ কর্মপ্রার্থী বেকার ভাতা পাওয়ার আশায় সেখানে নাম লেখায়। এদের মধ্যে থেকেই ১ লক্ষ বেকারকে বেছে ভাতা দেওয়া হবে। সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নাম নথিভুক্ত করেছেন, এমন প্রথম ১ লক্ষ যোগ্য বেকারকে এই ভাতা দেওয়া হবে।
প্রশ্ন উঠেছে ওয়েভার স্কিম থেকে কত টাকা আদায় করা সম্ভব? কর্তারা জানাচ্ছেন, রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের সংস্থা, বড় দোকান, কল-কারখানা, বাণিজ্য কেন্দ্র মিলিয়ে অন্তত ২ লক্ষ সংস্থা রয়েছে, যারা বৃত্তি কর দেয় না। অথচ এই সব সংস্থায় টানা ১২ মাস কাজ করলেই প্রত্যেক কর্মচারীর বৃত্তি কর দেওয়া বাধ্যতামূলক। বেতন থেকেই এই টাকা কেটে সরকারের ঘরে জমা দেওয়ার কথা সংস্থারই। কিন্তু বহু সংস্থা বছরের পর বছর তা জমা দেয়নি। ফলে বকেয়া আদায়ের আশা ছেড়ে এখন ওয়েভার স্কিম চালু করে মাত্র দু’বছরের টাকা আদায় করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে অন্তত এ বারের বেকার ভাতার টাকা উঠে আসবে।
কী ভাবে? জানা গিয়েছে, বৃত্তি কর নেওয়া হয় মাসে ১২০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। ওয়েভার স্কিমে সংস্থা ও ব্যক্তির ক্ষেত্রে দু’রকমের হিসেব ঠিক করা হয়েছে, যার মধ্যে টাকার হেরফের সামান্যই। কোনও সংস্থা যদি কর্মী পিছু মাসে ২০০ টাকা হারে ২ বছরের জন্য ৪৮০০ টাকা দেয়, তা হলেই হবে। আবার ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে বছরে ২৫০০ টাকা করে দু’বছরের কর মেটালে বাকি বকেয়া মকুব। সরকারি কর্তাদের আশা, অন্তত ৫০ হাজার সংস্থা ওয়েভার স্কিমের সুযোগ নিলেই এ বছরের বেকার ভাতার থেকে বেশি টাকা উঠে আসবে।
কেন সরকার বকেয়া বৃত্তি কর আদায়ে জোর না দিয়ে এ ভাবে মকুবের পথে হাঁটল?
কর্তারা জানান, ব্যক্তিপিছু বৃত্তি কর আদায়ের পরিমাণ বছরে মাত্র ১৪৪০ থেকে ২৪০০ টাকা। কেউ না দিলে তাঁকে নোটিস পাঠিয়ে তা আদায় করতে যাওয়ার খরচ এর থেকে বেশি। বাধ্য হয়ে কর ফাঁকি সামলে আয় বাড়াতেই ওয়েভার স্কিমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির বকেয়া কর আদায়ের ক্ষেত্রে ওয়েভার স্কিম চালু করে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের আমলে মোটা টাকা তুলেছিল কলকাতা পুরসভা। এ বারে একই ধরনের স্কিম বৃত্তি করের ক্ষেত্রেও চালু করছে সরকার। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসারে এ ছাড়া আর উপায় ছিল না বলেই মত কর্তাদের। |