বাঙালির ব্যবসা হয় না কার্যত কলকাতার সব বড় ব্যবসাই অবাঙালিদের হাতে। এই কথাটা যেমন সত্যি, একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে রমাপ্রসাদ গোয়েন্কার মতো মানুষকে শুধু পারিবারিক পরিচয়ের কারণে, ‘অবাঙালি’ তকমা দেওয়া অর্থহীন। বৃহৎ বাঙালি-র সংজ্ঞায় তিনি ষোলো আনা বাঙালি।
প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, ভালবাসতেন মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শুনতে। বাঙালিদের মতো প্রবল উৎসাহ ছিল রাজনীতিতেও। ২০ বছর বয়সে কংগ্রেসের সদস্যপদ নিয়েছিলেন। ২০০০ সালে রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছিলেন। আবার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গেও রমাপ্রসাদের সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল। সেই সময় হলদিয়া পেট্রোকেমের অন্যতম পুরোধাও ছিলেন তিনি।
বাঙালির মতো আড্ডাবাজও ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় কফি হাউস থেকে যে আড্ডার শুরু, তা চলেছে আজীবন। বন্ধু-তালিকায় যেমন কোটিপতি ব্যবসায়ীরা ছিলেন, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিক বা বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন। তেমনই ছিলেন কিছু নিতান্ত সাধারণ মানুষ। |

শেষযাত্রা। কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। |
সামাজিক অবস্থানের কথা না ভেবেই মিশতে জানতেন রমাপ্রসাদ। একেবারে বাঙালিদের মতোই। ভালবাসতেন পড়তে। ইতিহাস থেকে দর্শন, অর্থনীতি থেকে আধ্যাত্মিক জগৎ, বিস্তৃত আগ্রহ ছিল তাঁর। এক বার কার্ল মার্কস-এর এক দুষ্প্রাপ্য জীবনী পড়ার ইচ্ছা হয়েছিল। কোনও দোকানে বইটি পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত আলিমুদ্দিনের লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে পড়লেন।
দুই ছেলের মধ্যে ব্যবসা ভাগ করে দিয়ে দৈনন্দিন কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন বটে। কিন্তু শেষ দিন অবধি ‘বিপদে-আপদে’ বা বড় কোনও সিদ্ধান্তের আগে শলা-পরামর্শের জন্য এই ভূয়োদর্শী মানুষটির কাছেই হাজির হতে অভ্যস্ত ছিল এ রাজ্যের শিল্পমহল।
রমাপ্রসাদের জন্ম ১৯৩০ সালে। উত্তর কলকাতার চোরবাগানের বাড়ি থেকেই পড়াশোনার শুরু। ম্যাট্রিক দেন অবশ্য বেনারস থেকে। তার পর ফের কলকাতায়, প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসে স্নাতক স্তরের ছাত্র। তাঁর ঠাকুরদা, বাবাও এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি। ব্যবসায় হাতেখড়ি অবশ্য বাড়িতেই। বাবা কেশবপ্রসাদ গোয়েন্কার কাছে। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্যবসাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেশের অন্যতম অগ্রণী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন রমাপ্রসাদই।
পারিবারিক সূত্রে হাতে আসা ফিলিপস কার্বন ব্ল্যাক, এশিয়ান কেবল্স, আগরপাড়া জুট এবং মারফি ইন্ডিয়াকে একত্রিত করে ১৯৭৯ সালে আরপিজি এন্টারপ্রাইজেস প্রতিষ্ঠা করেন রমাপ্রসাদবাবু। তার পরের তিন দশক জুড়ে নিজের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন তিনি। পুরনো ব্যবসা বিক্রি করেছেন, কিনেছেন একের পর নতুন সংস্থা। সেই সূত্রেই ‘টেকওভার স্পেশ্যালিস্ট’ হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠেছিল গোটা দেশে।
বৈষয়িক বুদ্ধি যেমন ছিল, তেমনই ছিল নিজের হৃদয়ের কথা শোনার অভ্যাসও। ১৯৮৬ সাল তার একটা বড় প্রমাণ পেয়েছিল। সে বছর গ্রামাফোন কোম্পানির ভারতীয় ব্যবসা, এইচএমভি কিনে নেন রমাপ্রসাদ। নিজে গান শুনতে ভালবাসতেন। বিশেষত হিন্দুস্তানি মার্গসংগীতের চৈতি গান ছিল তাঁর অতি পছন্দের। ভালবাসার জায়গাটির সঙ্গে ব্যবসায়িক উদ্যোগকে জুড়ে নিয়ে তিনি তৈরি করেন সারেগামা।
আবার ব্যক্তিগত আগ্রহ যাতে ব্যবসার পাখির চোখকে ঢেকে না দেয়, সে বিষয়েও সমান সজাগ ছিলেন রমাপ্রসাদ। নিজে জুট টেকনোলজি পড়েছিলেন। বিষয়টিতে যথেষ্ট আগ্রহও ছিল তাঁর। কিন্তু ১৯৭৯ সালে পারিবারিক ব্যবসা ভাগ হওয়ার পর যখন তিনি চটকলের মালিকানা পেলেন, সেই ব্যবসার মলিন ভবিষ্যৎকে বুঝে নিতে ভুল করেননি তিনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেচে দিয়েছিলেন চটকল। সেই টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন অন্য ব্যবসায়।
রমাপ্রসাদের ব্যবসার আয়তন এবং বৈচিত্র বেড়েছে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ১৯৮০ সালে সিয়াট টায়ার্স। ১৯৮১-তে ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা কেইসি ইন্টারন্যাশনাল। ১৯৮৩ সালে সার্ল ইন্ডিয়া (এখন যা আরপিজি লাইফ সায়েন্সেস নামে পরিচিত)। ১৯৮৪ সালে মনু ছাবড়িয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ডানলপ অধিগ্রহণ (পরে অবশ্য মনোমালিন্যের জেরে সংস্থা ছাড়েন তিনি)। তবে সব থেকে নজরকাড়া ঘটনাটা ঘটল সম্ভবত ১৯৮৯ সালে ব্রিটিশ বিদ্যুৎ সংস্থা সিইএসসি কিনে নিলেন রমাপ্রসাদ। একই বছরে আরপিজি গোষ্ঠীর নতুন সদস্য হল স্পেন্সার্স। |

গোয়েন্কা হাউসে আরপিজি-পুত্রদের সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী। |
রমাপ্রসাদ নিজে অবশ্য আগাগোড়া মনে করতেন, ১৯৬৩ সালে কোচিন রিফাইনারির শেয়ার কেনাই তাঁর প্রথম বড় পদক্ষেপ। সে কথা যেমন আজীবন মনে রেখেছেন, তেমনই এত সাফল্যের ভিড়েও সারা জীবনে কখনও ভোলেননি বম্বে ডাইং হাতছাড়া হওয়ার দুঃখ। কয়েক বছর আগেও এক বণিকসভার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “এখনও ভাবলে চোখে জল আসে। চুক্তিপত্রে সইও হয়ে গিয়েছিল। তবু অধরা থেকে গেল।” জানিয়েছিলেন, চুক্তিপত্রটি নষ্ট করেননি তিনি। চেয়েছিলেন, অন্তত ব্যর্থতার খতিয়ান হিসেবে সেটা থেকে যাক। যাতে সেই স্মৃতি পরবর্তী ভুলকে আটকে দিতে পারে।
২০১০ সালেই দুই ছেলে হর্ষ ও সঞ্জীবের মধ্যে নিজের ব্যবসা ভাগ করে দেন রমাপ্রসাদ। পারিবারিক ব্যবসা ভাগ হওয়া মানে যেখানে প্রকাশ্যে কলহই দস্তুর, সেখানে আর পি জি এন্টারপ্রাইজেসের বাঁটোয়ারা ছিল রীতিমতো তাৎপর্যপূর্ণ। কী ভাবে সন্তানদের মধ্যে ব্যবসা ভাগ করে দিতে হয়, নিজের বাবার উদাহরণ থেকেই শিখেছিলেন রমাপ্রসাদ। দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে অব্যাহতি নিয়ে তিনি থেকে যান সেই ব্যবসা-সাম্রাজ্যের চেয়ারম্যান এমেরিটাস হিসেবে। ছেলেদের বলেছিলেন, ‘‘আমার মতামত না নিলেও চলবে। কিন্তু আমার পরামর্শ চাইলে সেই পরামর্শ মেনেই কাজ করতে হবে।’’
অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন জীবনে। বরাবর শীর্ষ স্তরে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বিভিন্ন বণিকসভায়। আইআইটি খড়্গপুরের বোর্ড অফ গভর্নসের চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। প্রায় সর্বত্র আদৃত ছিলেন পরামর্শদাতা হিসেবেও। সে সব সত্ত্বেও বছর পাঁচেক আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “জীবনের লম্বা সফরের দিকে ফিরে তাকালে ‘কী পেয়েছি’র পরিবর্তে ‘আর কী করা যেত’র চিন্তাই মনে বেশি ভিড় করে।” সাফল্যের এই অফুরান খিদেই সম্ভবত এ দেশের শিল্পপতিদের মধ্যে প্রথম সারিতে বসিয়েছিল তাঁকে। |