• বিশ্বভারতীতে আপনার ১৮ মাস হয়ে গেল। কী করতে পেরেছেন?
সার্বিক শিক্ষার (‘হোলিস্টিক এডুকেশন’) যে ধারণা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল, সেই ঐতিহ্য রূপায়ণের চেষ্টা করছি। আমরা বিজ্ঞানে পাঁচ বছরের একটা ‘ইন্টিগ্রেটেড এমএসসি’ প্রোগ্রাম শুরু করেছি, যা পড়ার সময়ে কিন্তু সঙ্গীত বা মানববিদ্যার কিছু কোর্সও করা যায়। সেই সঙ্গে বিদেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমরা চুক্তি করছি, যাতে ‘ক্রেডিট ট্রান্সফার’ ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের ছাত্ররা কয়েকটা কোর্স সেই সব প্রতিষ্ঠান থেকে করতে পারে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইআইএম কলকাতার সঙ্গে ইতিমধ্যেই আমাদের এ বিষয়ে সংযোগ হয়েছে। আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আদান-প্রদানে বিশ্বাসী। যেখানে যে পাঠক্রম, গবেষণার উত্কর্ষ বেশি, সেখানে ছাত্ররা সেই বিষয়টা নিয়ে কাজ করবে।
• কোন কোন বিষয়ে বিশ্বভারতীর উত্কর্ষ বিশ্বমানের? কলা, সঙ্গীত, গ্রাম পুনর্গঠনের বিভাগগুলি পঠন-পাঠনে দেশের সেরা বিভাগের মধ্যে পড়ে। বিনয় ভবনে শিক্ষকদের জন্য পাঠক্রমগুলোও (বি এড, এম এড) বেশ ভাল। এগুলিকে গ্রাম পুনর্গঠনের সঙ্গে সমন্বয় করা আমরা একটা লক্ষ্য। বিশ্বভারতীর বিশেষত্ব এই যে, আমরা জ্ঞানচর্চার বিষয়কে হাতে-কলমে সমাজে প্রয়োগের সুযোগ দিতে পারি। সাধারণ মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ সংযোগই আমাদের ঐতিহ্য।
• আর বিজ্ঞান? বিজ্ঞানের চর্চায় বিশ্বভারতীর অবদান হবে বিজ্ঞানের নানা ধারার মধ্যে আদান-প্রদানের কাজে। আমরা সেটাই করতে চেষ্টা করছি আইনস্টাইন ভবনে। সেখানে বেদান্তের সঙ্গে কোয়ান্টাম ফিজিক্স, নিউরোবায়োলজির সঙ্গে কগনিশন সায়েন্স, জ্ঞানের এমন নানা ধারার সম্পর্ক-সমন্বয় নিয়ে কাজ হবে। বিশ্বভারতীতে গবেষণাগার-নির্ভর বিজ্ঞান (এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্স) করার সুযোগ খুব বেশি, এমন বলা চলে না। এখানে ভাল হতে পারে কৃষি বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞানের চর্চা। অ্যাগ্রো-ইকনমিকস, অ্যাগ্রো-স্ট্যাটিসটিক্স, এই বিষয়গুলো বিশ্বভারতীর পক্ষে বেশি প্রাসঙ্গিক। |
উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত।—নিজস্ব চিত্র। |
• বিজ্ঞানের সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। তারপর বিশ্বভারতীর ‘বিকল্প শিক্ষা’ মডেল কেন?
কেন নয়? বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা নিয়ে নতুন করে চিন্তা করছে। জ্ঞানচর্চাকে নানা বিষয়ে খণ্ডিত না রেখে একটা সামগ্রিক শিক্ষার আদর্শকে গ্রহণ করছে। তাছাড়া, ‘এলিট’ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ইচ্ছের মধ্যে একটা স্বার্থপরতা রয়েছে। গবেষণা হওয়া দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেই।
• বিশ্বভারতীতে বিরোধিতা কম নয়। কাজ করছেন কী করে? করতে পারছি, কারণ ‘বাঙালি ভদ্রলোক’ বলতে যা বোঝায় আমি তা নই। ব্রাহ্ম নই, প্রেসিডেন্সিতে পড়িনি, লন্ডনে যাইনি। হিন্দু স্কুলে ডানপিটেমো করেছি বেশি। ক্লাস কেটে ‘ওহ কৌন থি’ ফিল্ম দেখতে গিয়ে সামনের সিটে মাকে দেখে লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল। বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে ফিজিক্স অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি, প্রেসিডেন্সিতে পড়ানোর চাকরি ছেড়ে গবেষণা করতে গিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রে, বিয়ে করেছি কনের বাড়ির অমতে। দেশে ফিরে কাজ করেছি প্রথমে কালাপক্কমের আণবিক শক্তি বিভাগে তার পরে হায়দরাবাদ, দিল্লিতে। আমার চামড়া পাতলা নয়।
• এ রাজ্যে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন? প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল অদ্ভুত। এস এন বোস ইনস্টিটিউটে ঢুকে দেখি ক্যাম্পাসে মানুষ-সমান উলুখাগড়ার বন। কফি মেশিন কাজ করে না কেন, প্রশ্ন করলেও শুনতে হয়, ‘ওটা সাবজুডিস।’ কয়েক বছরে সব মামলা শেষ করলাম। নতুন কোর্স শুরু হল, অনেক ছাত্র-গবেষক এল, নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগ শুরু হল। ফাঁকিবাজ অধ্যাপককে শো-কজ করায় যৌন হয়রানির অভিযোগও হল আমার বিরুদ্ধে। তা খারিজও হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমার হয়রানি কম হয়নি। তবু মনে করি, ঠিক করেছি। বিদেশে আমি বিশ্বসেরা অধ্যাপকদের কাছ থেকে অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতা আজও আমার কাজের শর্ত। স্বাধীনতা পেয়েছিলাম বলেই, হরিণঘাটার মোহনপুরে প্রত্যন্ত এলাকায় ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ প্রতিষ্ঠা করে উত্কর্ষের একটা স্তরে পৌঁছে দিতে পেরেছি।
• বিশ্বভারতীতে চিন্তার স্বাধীনতা কতটা পাচ্ছেন?
এখানে এক শ্রেণির মানুষ আছেন, যাঁদের আমি বলি ‘রাবীন্দ্রিক মুটে।’ রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো তাঁরা ঝুড়ি বোঝাই করে বয়ে নিয়ে চলেছেন, কেবল ভয়, বুঝি কলাটা-মুলোটা খসে পড়ল। অথচ রবীন্দ্রনাথের সব চাইতে কাছের মানুষ যাঁরা ছিলেন, সেই জগদীশচন্দ্র বসু, প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশ চিন্তার দিক থেকে স্বতন্ত্র ছিলেন। রবীন্দ্র-ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার চ্যালেঞ্জ।
• কিন্তু আশ্রম ঘিরে মস্ত পাঁচিল? রবীন্দ্র-ঐতিহ্য বিরোধী নয়?
তা বলে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ আউড়ে লোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি দখল করবে, সে-ও হতে দেওয়া যায় না। |