নিজস্ব সংবাদদাতা • রানিগঞ্জ |
প্রস্তুতি তুঙ্গে। এক দিন পরেই বাসন্তীপুজো রানিগঞ্জে। কোথাও গুরুর আদেশ, কোথাও বা স্বপ্নাদেশ। আবার কোথাও বা বাসিন্দাদের চাহিদাতেই বাসন্তীপুজো শুরু হয়েছিল খনি ও শিল্পাঞ্চলে। সেই ঐতিহ্য চলছেই।
অন্ডাল গ্রামে সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মামারবাড়ি চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজো এখন সর্বজনীন। প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এই পুজো। পরিবারের সপ্তম পুরুষ খোকন চট্টোপাধ্যায় জানান, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন, সে বছর এলাকায় বসন্ত রোগ মহামারির আকার নিয়েছিল। তার হাত থেকে বাঁচতেই বাসন্তী পুজো শুরু করেছিল তাঁদের পরিবার। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে এই পুজো সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। পুজো পরিচালনা করেন অন্ডাল গ্রাম বাসন্তী ষোলআনা কমিটি। পুজোর এক সপ্তাহ পর কীর্তনের আয়োজন হয়। চারদিন ধরে চলে তা। তার পরেই দেবীমূর্তি বিসর্জন হয়।
বারাবনির জামগ্রামে রাউত পরিবারের পুজো শুরু হয়েছিল ১৯৪৫ সালে। ওই পরিবারের সদস্য নিমাই রাউত জানান, কালীপদ রাউতের এক ছেলে মারা যায়। বিষয় সম্পত্তি রক্ষার জন্য তিনি পুজো শুরু করেন। |
বারাবনির জামগ্রামে একটি পুজো মণ্ডপ। নিজস্ব চিত্র। |
তারপর তাঁর মেয়ে ও জামাই এই পুজো চালিয়ে যান। এখন তাঁর দৌহিত্ররাই এই পুজোর আয়োজন করে আসছে। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, এলাকায় আর কোনও পুজো হয় না। তাই সবাই এই মন্দিরেই পুষ্পাঞ্জলি দেন।
প্রায় আড়াইশো বছর আগে জামুড়িয়ার ইকড়ায় বাসন্তী পুজো শুরু করেছিলেন বিজয় গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের পরিবারের প্রবীণ সদস্য চিত্তরঞ্জনবাবু জানান, বিজয় গোবিন্দকে নিয়ে জনশ্রুতি এলাকায় সুবিদিত। তাঁরা জানতে পেরেছেন, বিজয়গোবিন্দবাবু স্থানীয় চৌকিডাঙা কোলিয়ারিতে কাজ করতেন। ইকড়া গ্রাম ঢোকার আগে একটি জোড় আছে। চৈত্রের দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে সেই জলে হাত মুখ ধুতে বিজয়বাবু সেখানে নামেন। সেখানে এক বালিকাকে দেখেন তিনি। জানতে চান, এই দুপুরে সে কেন এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। হঠাৎ সেই বালিকা উধাও হয়ে যায়। সেই রাতেই বিজয়বাবু স্বপ্ন দেখেন, বাসন্তী দেবী সেই মেয়েটি হয়ে তাঁর কাছে এসেছিল। সে তাঁকে পুজো করতে বলে। সেই বছরই গ্রামে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গামন্দিরে এই পুজো শুরু হয়। এক বছর বিজয়বাবু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখেন। একে একে সাতটি কোলিয়ারির মালিক হন। একটি মন্দির তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠা করেন বাসন্তী বিজয় উচ্চ বিদ্যালয়। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই মণ্ডপে একদিন বাউল ও দু’দিন যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গ্রামের বাসিন্দা বুধন বাউড়ি, বাবন বাগদি এবং তপন ঘোষেরা জানান, বালানপুর, শেখপুর, সার্থকপুর এবং চণ্ডীপুরের বাসিন্দারাও এই পুজোয় সামিল হন।
ডিসেরগড়ের চট্টোপাধ্যায় বাড়ির পুজো শুরু করেছিলেন প্রয়াত অমরনাথ চট্টোপাধ্যায়। প্রায় ৬৫ বছর আগেকার কথা। বাড়ির সদস্য বিমান চট্টোপাধ্যায় জানান, অমরনাথবাবুকে তাঁর গুরু পুজো আয়োজনের আদেশ দিয়েছিলেন। জামুড়িয়ার হিজলগড়া গ্রামে চক্রবর্তী বাড়ির পুজো একশো বছর অতিক্রান্ত। এছাড়াও প্রায় অর্ধ শতাব্দীরও বেশি প্রাচীন বার্নপুরের গৌরাঙ্গ সরণি রাস্তায় রামকৃষ্ণ পূর্ণানন্দ আশ্রমের পুজো। আসানসোলের ধ্রুবডাঙার মহারানি স্থানে বাসন্তী মায়ের প্রতিমার আবার ১৮টি হাত। নবরাত্রি পুজো হিসেবে পরিচিত তা। বারাবনির দনার্দনসায়রে রায় পরিবারের পুজো এ বার ৭৩ বছরে পড়ল। সন্তান কামনায় এই পুজো শুরু হয়েছিল বলে পরিবার সূত্রে খবর।
রয়েছে নানা ক্লাবের পুজোও। হিরাপুরের বার্নপুর অ্যাথলেটিক ক্লাব ২৫ বছর আগে বাসন্তী পুজো শুরু করে। আয়োজক সংস্থার সদস্য অভিজিৎ গুপ্ত জানান, ২৫ বছর আগে তাঁরা একটি দাতব্য চিকিৎসালয় চালু করেন। এর আগে সরস্বতী পুজো হত। কিন্তু দাতব্য চিকিৎসালয়ের তহবিলের জন্য বাসন্তী পুজোই আদর্শ। তখন থেকেই বাসন্তী পুজো শুরু করেন তাঁরা। এই পুজোর আয়ে সারা বছর তাঁদের দাত্যব্য চিকিৎসালয়টি চলে। পাণ্ডবেশ্বরের পল্লিমঙ্গল সমিতির পুজো শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। ওই পুজো কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কানাই মণ্ডল জানান, দুর্গা ও কালীপুজো ছাড়া আর কোনও উৎসবই হত না আগে। অথচ খনি এলাকায় তার চাহিদা ছিল। এলাকাবাসীর উৎসাহেই পুজো শুরু হয়। |