পুরপিতা পার্থর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ ছাত্রের
হম্মদ ইকবাল, শম্ভুনাথ কাওয়ের পরে পুলিশের খাতায় উঠল আর এক তৃণমূল কাউন্সিলরের নাম। বুধবার তৃণমূলের যে মিছিল থেকে প্রেসিডেন্সির উপরে হামলার অভিযোগ ওঠে, তার নেতৃত্বে ছিলেন পার্থ বসু। শুক্রবার রাতে তাঁর নামে পুলিশে অভিযোগ করেন প্রেসিডেন্সির ছাত্র দেবর্ষি চক্রবর্তী। একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ নথিভুক্ত করেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সম্পাদক তমোঘ্ন ঘোষের নামেও। প্রেসিডেন্সির ঘটনায় এ পর্যন্ত তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পাঁচ ছাত্রকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ (যার ফলে শাসক দলের অস্বস্তিও বেড়েছে)। কিন্তু নেতৃস্থানীয় কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই হয়নি শুক্রবার পর্যন্ত। পার্থ ও তমোঘ্নর বিরুদ্ধে জোড়াসাঁকো থানায় ডায়েরি করে সেই কাজটাই করলেন দেবর্ষি।
দেবর্ষি ও তাঁর এক সহপাঠীর বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে ঢিল ছোড়ার অভিযোগ এনে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিল তৃণমূল। সেই মামলায় ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আত্মসমর্পণও করেন দেবর্ষিরা। আদালত অবশ্য ঢিল ছোড়ার তত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছে। ফলে দু’জনেই জামিন পেয়ে গিয়েছেন। দেবর্ষি এ দিন জানান, ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবারই পার্থ-তমোঘ্নর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু তখন তাঁর নিজের বিরুদ্ধে তৃণমূলের করা পাল্টা অভিযোগটি ছিল। তাই ওই দিন পুলিশের কাছে যাননি দেবর্ষি। শুক্রবার জামিনে মুক্ত হওয়ার পরেই জোড়াসাঁকো থানায় যান অভিযোগ দায়ের করতে।
মিছিলে পার্থ বসু।
কলকাতা পুরসভার ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পার্থ বসু। তাঁকে নিয়ে গত দু’মাসে মহানগরের তিন জন তৃণমূল পুরপিতার নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করা হল। ইকবালের নাম উঠেছিল গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে। মাঠপুকুর কাণ্ডে গ্রেফতার হন শম্ভুনাথ। এই দু’জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগে মামলা চলছে। পার্থবাবুর নামে দেবর্ষি শুক্রবার রাতে অভিযোগ দায়ের করলেও শনিবার পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে সম্পর্কে পুলিশ কিছু বলতেও চায়নি। অভিযোগটি শুধু ‘জেনারেল ডায়েরি’ হিসেবেই রাখা হয়েছে। শনিবার পর্যন্ত পুলিশ এফআইআর-ও করেনি। পুলিশের বক্তব্য, আপাতত অভিযোগ সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
এ দিন কলকাতায় তৃণমূলের এক মিছিলে পার্থবাবুকে হাঁটতে দেখা গিয়েছে। সেখানেই তিনি বলেন, “এ রকম অভিযোগ মমতাদির নামেও অনেক হয়েছে। এটা মিথ্যা অভিযোগ। তবে দলের সিদ্ধান্ত মেনেই পদক্ষেপ করব।” অন্য অভিযুক্ত তমোঘ্নর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
পার্থ-তমোঘ্নর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?
জোড়াসাঁকো থানায় দেবর্ষি অভিযোগ করেছেন, বুধবার দুপুরে পার্থ বসু ও তমোঘ্ন ঘোষের নেতৃত্বে ৬০-৭০ জনের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের সদর দরজা ভেঙে ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢুকে তাঁকে এবং তাঁর বন্ধুকে মারধর করেন। সঙ্গে চলে অকথ্য গালিগালাজ। হামলাকারীদের মধ্যে পার্থ ও তমোঘ্নকে তিনি চিনতে পেরেছেন বলে জিডি-তে জানিয়েছেন দেবর্ষি। পার্থবাবু যে মিছিলের সামনে থেকে হামলায় উস্কানি দিয়েছেন, সে কথা পুলিশের একটি সূত্রও মেনে নিয়েছে। তাদের আরও বক্তব্য, এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে তালা দেওয়া থাকলেও থামে উঠে কয়েক জন তৃণমূলের পতাকা লাগানোর পর পার্থবাবু বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ইউনিটের প্রতিষ্ঠা হল এবং ওই পতাকা কেউ নামাতে পারবে না।
এখানে প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ যেখানে হাজির ছিল, সেখানে তাদের সামনে এমন ঘটনা ঘটল কী ভাবে?
পুলিশ সূত্রের খবর, বুধবার দুপুরে কলেজ স্ট্রিটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে জড়ো হওয়া তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশ্য ঠাহর করতে না-পারার ফলেই ওই কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, শ’দেড়েক লোকের একটি মিছিল সে দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলুটোলা স্ট্রিট, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ হয়ে গাঁধী মূর্তির পাদদেশে জড়ো হবে বলে ঠিক ছিল। সেই মতো জোড়াসাঁকো থানার ওসি-র নেতৃত্বে পুলিশি বন্দোবস্ত ছিল কলুটোলা স্ট্রিটের দিকে। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে বেরিয়ে মিছিল আচমকা বাঁয়ে ঘুরে প্রেসিডেন্সির দিকে এগোয়। আর এতেই ধোঁকা খেয়ে যায় পুলিশ। মিছিলের লেজের দিকে যে-ক’জন পুলিশের থাকার কথা ছিল, তাঁরাই তড়িঘড়ি তখন সামনে-পিছনে গিয়ে ‘কভার’ করার চেষ্টা করেন। মিছিল যখন প্রেসিডেন্সির ফটকে পৌঁছয়, তখন সেখানে মাত্র তিন জন পুলিশ ছিলেন। তৃণমূলের দেড়শো কর্মী-সমর্থককে সামলাতে সেই সংখ্যাটা নেহাতই নগণ্য।
প্রেসিডেন্সির রেজিস্ট্রারের সঙ্গে সন্তোষ সিংহ ওরফে পাপ্পু। শনিবার জোড়াসাঁকো থানায়।
পুলিশের দাবি, পার্থ-তমোঘ্নর সঙ্গে সে দিন মিছিলের সামনে ছিলেন সারা বাংলা তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতির কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের আহ্বায়ক মন্মথ বিশ্বাস। তৃণমূলের প্রবীণ নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে চড় মারার অভিযোগ উঠেছিল এই মন্মথর বিরুদ্ধেই। দেবর্ষির দায়ের করা অভিযোগে অবশ্য মন্মথর নাম নেই। পুলিশের একটি অংশের বক্তব্য, বিভিন্ন সূত্র থেকে যা জানা গিয়েছে তাতে ফটকের উপরে উঠে এক তৃণমূল সমর্থক পতাকা লাগাতে যেতেই বিপত্তি ঘটে। পায়ের ধাক্কায় থামের উপর থেকে চাঙড় বা ইটের টুকরো ভেঙে পড়ার কথা জানা গিয়েছে। সেটাই সম্ভবত তৃণমূলের স্থানীয় নেতা চিনু হাজরার মাথায় পড়ে। মাথা ফেটে রক্ত বেরোতে শুরু করে। পুলিশের এই তত্ত্ব অবশ্য মানতে পারেননি তৃণমূল নেতৃত্ব। পুলিশ সূত্রে আরও বলা হয়, এতেই খেপে যান তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। চিৎকার করতে থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর থেকে এসএফআই সমর্থকেরা তাঁদের লক্ষ করে ইট ছুড়ছেন। দেড়শো মানুষের ধাক্কায় এর পরে দরজার তালা ভেঙে যায়। তদন্তের জন্য পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ চেয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছে, তাদের সিসিটিভি নেই।
এর পরে পুলিশ হামলাকারীদের বুঝিয়ে সুজিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করার চেষ্টা করে। এক পুলিশ অফিসারের বক্তব্য, “একটি দল এর মধ্যেই গিয়ে যে বেকার ল্যাবরেটরিতে ভাঙচুর করছে, সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। জ্যাভেলিনের মতো অস্ত্রই বা কী করে ওখানে গেল, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না।” প্রশ্ন উঠেছে, প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষ যেখানে গণ্ডগোলের আশঙ্কা করে পুলিশকে আগাম খবর দিয়েছিলেন, সেখানে পুলিশ কেন সেই সম্পর্কে কোনও আঁচ পেল না? কেনই বা মিছিলের অভিমুখ সম্পর্কে আগাম খবর পাওয়া যায়নি? লালবাজারের কর্তারা অবশ্য গোটা বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে কলকাতা পুলিশের ডিসি (সেন্ট্রাল) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ বুধবারের ঘটনা নিয়ে পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে একটি রিপোর্ট দিয়েছেন। শনিবার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নার্সিংহোমেই দেখা করতে যান পুলিশ কমিশনার। তাঁদের দু’জনের মধ্যে কিছু ক্ষণ কথাবার্তা হয়। সরকারি এক সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রেসিডেন্সি-কাণ্ডে তদন্তের হাল হকিকৎ নিয়ে সিপি-র কাছে খোঁজ নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বুধবার কী ঘটেছিল জানতে এ দিন প্রেসিডেন্সির দারোয়ান সন্তোষ সিংহ ওরফে পাপ্পুকে থানায় নিয়ে গিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পাপ্পুর সঙ্গে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রবীর দাশগুপ্ত। পরে পাপ্পু বলেন, “সে দিন যা যা ঘটেছে, তা-ই পুলিশকে বলেছি।” পুলিশ সূত্রের খবর, জেরায় পাপ্পু হামলাকারীদের কারও নাম জানাননি। পুলিশ আরও জানায়, সে দিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে রেজিস্ট্রার প্রবীরবাবু ও কয়েক জন ছাত্রছাত্রীর বয়ানও রেকর্ড করা হবে।
পাপ্পুরা তিন প্রজন্ম প্রেসিডেন্সিতে কাজ করছেন। পাপ্পুর বাবা রামদেও সিংহ তো বটেই, দাদু রামইকবাল সিংহও প্রেসিডেন্সি কলেজের দ্বাররক্ষী ছিলেন। ১৯২৬ সালে দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে কলেজকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হন রামইকবাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে তাঁর নামে ফলকও রয়েছে।

—নিজস্ব চিত্র

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.