রাজারহাটের ফ্ল্যাটে যে রাতে পিয়ালি মুখোপাধ্যায়ের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ, সে দিন, অর্থাৎ ২৬ মার্চ সকালেই রাজ্যের এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সেখানে গিয়েছিলেন। ওই যুবতীর প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জেনেছে, আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মন্ত্রীর ওই মহিলা আত্মীয়ের সঙ্গে পিয়ালির তুমুল চেঁচামেচি হয়েছিল। তার জেরেই ওই ফ্ল্যাটে ‘একাকী’ পিয়ালি মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
ঘটনার পরে পিয়ালির ভাই প্রীতম জানিয়েছিলেন, তাঁর দিদির লেখা তিন লাইনের একটি সুইসাইড নোট পুলিশ তাঁকে এক ঝলক দেখিয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, তাতে লেখা: অবসাদগ্রস্ত, হতাশ ও একাকীত্বের জীবন থেকে তাঁর আর কিছু পাওয়ার নেই। তাই এই রাস্তাই তিনি বেছে নিচ্ছেন। প্রশ্ন উঠেছে, পেশায় আইনজীবী পিয়ালি গোটা দুয়েক সংস্থার পরামর্শদাতা ছিলেন। তৃণমূলের নেত্রী হওয়ার সুবাদে রাজনীতি নিয়েও কম ব্যস্ততা ছিল না। তাঁর বন্ধুবান্ধব, ঘনিষ্ঠজন
ও গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসাবাদ
করে পুলিশ জেনেছে, খুব কম সময়ই পিয়ালি রাজারহাটের ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন। দুপুরের মধ্যে কোর্টের কাজকর্ম সেরে সঙ্গীদের নিয়ে
কখনও কলকাতার নামকরা মলে, কখনও বা মহাকরণে চলে যেতেন। মাঝেমধ্যে বাড়ি ফিরতেও বেশ রাত হয়ে যেত। তার পরেও কেন পিয়ালি একাকীত্বে ভুগছিলেন, তার জবাব খুঁজছে পুলিশ।
তদন্তে পুলিশ জেনেছে, যে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ২৬ মার্চ সকালে পিয়ালির ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন, তিনিই ওই তৃণমূল নেত্রীকে আইনের স্নাতকোত্তর পড়ার ক্ষেত্রে ‘বেআইনি সুবিধা’ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে সুপারিশ নাকচ হয়ে গেলেও ‘কৃতজ্ঞতাবশত’ ওই মন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায় তাঁর। এর পাশাপাশি তৃণমূলের একাধিক নেতার সঙ্গে তাঁর ‘সখ্য’ গড়ে ওঠে।
পুলিশ জেনেছে, আদতে বর্ধমানের মেয়ে পিয়ালি এর পরে নিজেকে ‘প্রতিষ্ঠিত’ করতে কলকাতায় চলে আসেন। তার পিছনেও ওই মন্ত্রীর ‘ইন্ধন’ ছিল বলে এক পুলিশকর্তা জানিয়েছেন। পুলিশ বলছে, কলকাতায় পিয়ালির তেমন কোনও আত্মীয়-স্বজন না থাকায় ওই মন্ত্রী দক্ষিণেশ্বরে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে দেন তাঁকে। কিন্তু সেই খবর ওই মন্ত্রীর পরিবারের লোকজন জেনে গেলে তিনি পিয়ালিকে কেষ্টপুরের হানাপাড়ায় নিয়ে যান। পুলিশ জেনেছে, তত দিনে তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এবং সেই কারণেই হানাপাড়ার ৭৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ছেড়ে পিয়ালি চলে যান রাজারহাটের ২৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে। তার পরেই ওই ফ্ল্যাটে শুরু হয় তৃণমূলের একাধিক নেতা-মন্ত্রীদের যাতায়াত।
তদন্তকারী অফিসারেরা জেনেছেন, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পাশাপাশি কলকাতার এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গেও পিয়ালির যথেষ্ট সখ্যতা ছিল। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীরও ‘কাছের লোক’ ছিলেন ওই পুলিশ অফিসার এবং সেই সুবাদেই পিয়ালির সঙ্গে তাঁর ‘বন্ধুত্ব’ বেড়ে ওঠে। এমনকী, ব্যাঙ্কশাল কোর্টে ওই পুলিশ অফিসারকে অনেক বারই দেখা গিয়েছে পিয়ালির সঙ্গে। পুলিশ জেনেছে, মৃত্যুর আগের দিন, অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাতে ওই ‘পুলিশ বন্ধু’ই পিয়ালির সঙ্গে রাজারহাটের বাড়িতে ছিলেন। সে-ই ছিলেন এত দিনের ‘তৃতীয় ব্যক্তি’।
পুলিশ জানতে পেরেছে, ২৬ মার্চ বিকেল ৪টে থেকে রাত ৯টার মধ্যে পিয়ালির মৃত্যু হয়েছে। ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে মৃত্যুর সময় হিসাবে এটাই উঠে এসেছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ বলেন, “ঠিক ক’টায় পিয়ালির মৃত্যু হয়েছিল সেটা ময়না-তদন্তে জানা যায় না। এটুকু জানা গিয়েছে, ওই দিন বিকেলের পরে কোনও এক সময়ে পিয়ালির মৃত্যু হয়।”
|