সৌমিত্র কুণ্ডু • শিলিগুড়ি |
বনধ ডাকলেই শিলিগুড়ির জনজীবন যেন পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায়, এই ধারণাকে ফের ভেঙে দিলেন শহরবাসীদের অনেকেই। বৃহস্পতিবার বন উপেক্ষা করে স্কুল-কলেজ খোলা থাকল। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থাকল পুরোপুরি স্বাভাবিক। সরকারি তো বটেই, বেসরকারি যানবাহন চলল সকাল থেকেই। বেলা যত বেড়েছে, ততই রাস্তায় ভিড় বেড়েছে মানুষের। যদিও বনধ সফল না ব্যর্থ তা নিয়ে বামেদের সঙ্গে শাসক দলের তৃণমূলের চাপানউতোর চলেছে। বামেদের দাবি, বনধ সফল। পক্ষান্তরে, তৃণমূলের বক্তব্য, রাস্তাঘাটে যে ভাবে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেমেছেন তাতে বোঝা গিয়েছে বনধের রাজনীতির দিন শেষ হতে চলেছে।
সাতসকালেই জনজীবন স্বাভাবিক রাখার আর্জি জানিয়ে রাস্তায় নামেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। সকালে দলীয় নেতৃত্বের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শিলিগুড়ি জংশন স্টেশন, বিধান মার্কেট, সেবক মোড়, পানিট্যাঙ্কি মোড়, শেঠ শ্রীলাল মার্কেটের মতো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ব্যবসায়ীদের দোকান খুলতে অনুরোধ করেন। তাতে ব্যবসায়ীদের একাংশ উৎসাহী হয়ে দোকানপাট খুলে দেন। তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি’র জেলা সভাপতি অরূপ রতন ঘোষ অনুগামীদের নিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে বিভিন্ন রুটের চালু করিয়ে দেন। |
বন্ধ ব্যর্থ করতে রাস্তায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে। |
পরে কোর্ট মোড়ে এসে তাদের অটো চালকদের সংগঠনের অধীনে থাকা অটোগুলি চালুর ব্যবস্থা করেন। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম থেকে বিভিন্ন এলাকার বাস চলাচল করেছে। তবে বেসরকারি বাস ছিল কম। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা কাজকর্ম স্বাভাবিক ছিল। অধিকাংশ স্কুলে ইউনিট পরীক্ষা থাকায় তা হয়েছে। কোথায়ও বাম মনোভাবাপন্ন শিক্ষক সংগঠনের সদস্যরা স্কুল খুলতে চাইছেন না অভিযোগ পেয়ে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন গিয়ে তা খোলার ব্যবস্থা করেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী বলেন, “শিলিগুড়িতে উন্নয়নে গতি এসেছে বলে তাতে বিঘ্ন ঘটাতে চক্রান্ত হচ্ছে। অশান্তির ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মানুষ এ সব বরদাস্ত করবেন না সেটা বন্ধ ব্যর্থ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।”
এর আগেও নকশালদের ডাকা বন্ধে সাড়া না দিয়ে সাধারণ মানুষ জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করেছেন। সে সময়ও পথে নেমেছেন গৌতম দেব। বাংলা নববর্ষের মুখে এ বারও বন্ধে ব্যবসায়ীদের একাংশ বিরোধিতা করে দোকান খুলেছেন। এ দিন পুরসভা, শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর, কোর্ট ট্রেজারি-সহ সরকারি বিভিন্ন দফতর অন্যান্য দিনের মতোই খোলা ছিল। কাজও হয়েছে। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণের শিলিগুড়ি ডিপো থেকে এ দিন নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি-সহ বিভিন্ন স্থানীয় রুটে অন্তত ৫টি অতিরিক্ত বাস দেওয়া হয়।
প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রাস্তায় নেমে জোর করে দোকান খোলানোর চেষ্টা করেছেন। তবে তাতে মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাড়া দেয়নি। আমাদের কোথাও কোনও পিকেটিং এ দিন করা হয়নি। স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধ হয়।” |
বন্ধে সচল শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোড। |
এ দিন বেলা ৯ টা নাগাদ শিলিগুড়ি জংশন স্টেশন চত্বর, লাগোয়া বাসটার্মিনাস এলাকায় যান। ব্যবসায়ীদের দোকান খুলতে অনুরোধ করেন। সেখান থেকে তারা আসেন বিধান মার্কেটে, ক্ষুদিরামপল্লি সব্জি বাজারে। বন্ধে দোকান খুলবেন না ভাবলেও মন্ত্রীকে অনুরোধ করতে দেখে অনেকে এগিয়ে আসেন দোকান খুলতে। বিধানমার্কেটের ক্ষুদিরামপল্লি সব্জি বাজার খুলে যায়। বিধান মার্কেটের মাছ ব্যবসায়ী কিশোর সাহানি, মাংস ব্যবসায়ী রাজু সরকাররা কারবার শুরু করেন। শিলিগুড়ি খুচরা ফল এবং সব্জি ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুবল সাহা বলেন, “আমরা বনধে সমর্থন করি না। আচমকা এ ভাবে বনধ হলে ফল, সব্জি নষ্ট হলে আমাদের মতো ব্যবসায়ীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েন।”
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতাদের একাংশ এ দিন অভিযোগ করেন কয়েকটি ক্ষেত্রে বাম মনোভাবাপন্ন শিক্ষকরা স্কুল খুলতে গড়িমসি করছিলেন। খবর পেয়ে তারা গিয়ে স্কুল খোলাতে চাপ দেন। শহরের বিবেকানন্দ হাই স্কুলে এ দিন প্রধান শিক্ষক অনিমেষ মুখোপাধ্যায় গেট খুলতে গড়িমসি করছিলেন বলে অভিযোগ। স্কুলে শিক্ষকদের একাংশ বাম মনোভাবাপন্ন বলেই তারা স্কুল বন্ধ রাখতে সক্রিয় হন বলে অভিযোগ। ছাত্রছাত্রীরা ভিড় করলেও গেট না খোলায় তাদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতারা গিয়ে হইচই শুরু করলে গেট খোলা হয়। পরে স্কুলের ইউনিট পরীক্ষাও শুরু করা হয় তাদের চাপে। এ দিন চম্পাসারির শ্রীগুরু বিদ্যান্দির কর্তৃপক্ষও পড়ুয়ার উপস্থিতি কম থাকায় স্কুল ছুটি দেয়। শিক্ষক, কর্মীরা হাজিরা দিয়ে চলে যান। স্কুল পরিদর্শকের দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, স্কুলের চাবি পাওয়া যাচ্ছে না বলে তাদের অভিযোগ করেছিলেন কয়েক জন শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক বিশ্বনাথ দত্ত জানান, তিনি কাজে শহরের বাইরে রয়েছেন। তবে পড়ুয়া কম থাকায় এ দিন ক্লাস হয়নি। স্কুলের ইউনিট পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সারদামণি বিদ্যাপীঠ। তবে তৃণমূল চাত্র পরিষদের সদস্যরা গিয়ে হইচই করলে তিনি দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পরীক্ষা নিয়েছেন। বাম শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ শিলিগুড়িজেলা সম্পাদক তমাল চন্দ বলেন, “ঘোষিত বন্ধ হওয়ার চাপ সৃষ্টি করে স্কুল খোলা রাখা ঠিক নয়। বিশেষ করে মেয়েদের স্কুলের ক্ষেত্রে। কেন না কিছু ঘটে গেলে তার দায় কে নেবেন!” |