কাজিয়া ১
রাজ্যপালের ভাষায় আপত্তি সিপিএমের, নালিশ প্রণবকে
রাজধানীতে যোজনা কমিশনের সামনে মন্ত্রী নিগ্রহের ঘটনাকে ঘিরে রাজ্যপাল-সিপিএম দ্বৈরথ শুরু হল।
দিল্লিতে রাজ্যের মন্ত্রীদের নিগ্রহের ঘটনায় ক্ষুব্ধ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন যে ভাবে সিপিএমের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, তা নিয়ে গত কালই মুখ খুলেছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। আজ আরও এক ধাপ এগিয়ে এ নিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে অভিযোগ করলেন দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। রাষ্ট্রপতিকে লেখা চিঠিতে কারাট জানিয়েছেন, নারায়ণনের বক্তব্য অবাঞ্ছিত এবং রাজ্যপাল পদের সঙ্গে মানানসই নয়। রাজ্যপালের বক্তব্য খতিয়ে দেখে তাঁকে উপযুক্ত পরামর্শ দেওয়ার জন্যও রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছেন কারাট।
রাজ্যপালের তরফেও পাল্টা জবাব এসেছে। রাজভবনের তরফে সিপিএম নেতাদের ‘ভুল ধারণা’ দূর করতে চেয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন রাজ্যপালের প্রেস সেক্রেটারি। যার বক্তব্য, দীর্ঘ ছয় দশক ধরে কমিউনিজমের ছাত্র নারায়ণন সিপিএমের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির ভূমিকা ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত। যার ভিত্তিতেই তিনি পলিটব্যুরোর তরফে দুঃখপ্রকাশ করা হোক বলে দাবি করেছিলেন। রাজভবনের তরফে দেওয়া এই বিবৃতি নিয়েও সরব হয়েছেন সিপিএম নেতৃত্ব। দলের অভিযোগ, রাজ্য জুড়ে হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারকে রাজধর্ম পালন করার পরামর্শ না দিয়ে রাজ্যপাল যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তা রাজনৈতিক ভাষায় ভারাক্রান্ত।
সব মিলিয়ে এক নজিরবিহীন দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি। অথচ মাত্র ক’দিন আগেই, গার্ডেনরিচে দুষ্কৃতীর গুলিতে সাব ইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরীর মৃত্যুর পরে রাজ্যপাল তৃণমূল সরকারের কড়া সমালোচনা করলে তাঁকে বাহবাই জানিয়েছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। রাজ্যপালের বক্তব্যকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহারও করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু এ বারে নিজেরাই রাজ্যপালের নিশানা হওয়ায় মাঠে নেমেছেন বিমান বসু-প্রকাশ কারাটরা। ঠিক যে ভাবে গার্ডেনরিচ কাণ্ডের পরে রাজ্যপালকে ‘হলুদ কার্ড’ দেখিয়েছিলেন রাজ্য মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
রাজ্যপাল পদটি নিয়ে অবশ্য সিপিএমের দীর্ঘদিন ধরেই আপত্তি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের প্রশ্ন তুলে তারা বহু দিন ধরেই এই পদটি বিলোপের পক্ষে সওয়াল করেছে। কিন্তু এ বার দলের সাধারণ সম্পাদক যে ভাবে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন, তা আগে কখনও হয়নি। এই ঘটনাকে দলের অন্দরে আলিমুদ্দিনের পাশে কারাটের দাঁড়ানোর চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন অনেকে। কারণ যোজনা কমিশনের সামনে বিক্ষোভের ঘটনায় আলিমুদ্দিনের ক্ষোভের মুখে পড়েছেন কারাট। এসএফআই নয়, দিল্লি রাজ্য কমিটিই ভাবনাচিন্তা না করে ওই কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। কারাট দিল্লির রাজ্য শাখার দায়িত্বে। কাজেই তিনিও এই ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না। ওই ঘটনার জেরেই রাজ্য জুড়ে সিপিএমের অসংখ্য দলীয় অফিস এবং দলের একাধিক নেতা-কর্মীর উপর হামলা হচ্ছে। এবং এ জন্যও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেই দুষছেন রাজ্য নেতারা। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যপালের সমালোচনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে কারাট পশ্চিমবঙ্গে দলের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। রাজ্যপালের বিষয়টি নিয়ে সিপিএম নেতৃত্ব রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানান পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি।
গত কালই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছিলেন, “পুলিশ কী ভাবে কাজ করতে পারে, তা রাজ্যপাল জানতে পারেন। কিন্তু পলিটব্যুরো বা সিপিএমের কমিটিগুলি কী ভাবে কাজ করে, তা রাজ্যপালের জানা নেই। এটা তাঁর অজ্ঞতা।” সিপিএম নেতাদের যুক্তি ছিল, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু ও সূর্যকান্ত মিশ্ররা নিজেরাই পলিটব্যুরোর সদস্য। তাঁরা আলাদা ভাবে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। ঘটনার নিন্দা করেছেন। তাঁরা যে পলিটব্যুরোর মতই প্রকাশ করছেন, সেটা রাজ্যপালের বোঝা উচিত ছিল। ওই ঘটনার পরে পলিটব্যুরোর তরফে বিবৃতি দিয়ে নিন্দা করা হয়েছিল।
বিমানবাবুর সমালোচনার পাল্টা জবাব দিয়ে আজ রাজভবনের তরফে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘গত ছয় দশক ধরে এম কে নারায়ণন কমিউনিজমের ছাত্র। তিনি মার্ক্স, এঙ্গেলস ও মাওয়ের সমস্ত লেখা পড়েছেন এবং আত্মস্থ করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন সম্মেলনে নারায়ণন কমিউনিজম বিষয়ে বক্তৃতাও দিয়েছেন। কাজেই তিনি সিপিএমের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত। রাজ্যপাল ভাল করেই জানেন, কমিউনিস্ট মতাদর্শের অন্যতম প্রধান নীতি হল গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে রাজ্যপাল পরামর্শ দিয়েছিলেন, সিপিএমের নিচুতলার কর্মী ও শাখার কাজকর্মের জন্য পলিটব্যুরোর তরফে দুঃখপ্রকাশ কাম্য’।
রাজভবনের বিবৃতির সমালোচনা করে মহম্মদ সেলিম বলেন, “রাজ্যপাল কত বছর মার্ক্সবাদ বা গাঁধীবাদ চর্চা করেছেন, সেটা বিচার্য বিষয় ছিল না। পলিটব্যুরোর কী করা উচিত, সে ব্যাপারে উপদেশ দিয়েছিলেন। তখন রাজ্য জুড়ে অশান্তি চলছে, বিরোধী দলগুলির কার্যালয় ভাঙা হচ্ছে, বিরোধী নেতা-কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। রাজ্য সরকারকে রাজধর্ম পালন করার পরামর্শও রাজ্যপাল দেবেন, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। তা না-করে তিনি বিবৃতি দিয়েছিলেন, যেটা রাজনৈতিক ভাষায় ভারাক্রান্ত।”
রাজ্যপাল তাঁর গত কালের বিবৃতিতে বলেছিলেন, “এই ঘটনায় যাঁরা দায়ী এবং যাঁরা এতে ইন্ধন জুগিয়েছেন, তাঁরা গণতান্ত্রিক কাঠামোয় কাজ করার অধিকার হারিয়েছেন। বিষয়টি এতটাই গুরুতর যে সিপিএম পলিটব্যুরোর প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত।” এই প্রসঙ্গেই রাষ্ট্রপতির কাছে কারাটের দাবি, “রাজ্যপালের তরফে এই ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যুক্তিযুক্ত কি না, ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তা আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” কারাটের অভিযোগ, গোটা পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ও অন্য বাম দলগুলির কার্যালয়ে, নেতা-কর্মীদের উপরে হামলা হচ্ছে। রাজ্যপালের বক্তব্য সেই হামলায় উৎসাহ দিচ্ছে।
রাজ্যপালের বিবৃতিতে তাঁদের দলকে যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ বলে অভিযোগ করে কারাট রাষ্ট্রপতির কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, নারায়ণন কী ভাবে কলকাতার রাজভবনে বসে এমন ভুল ও ভিত্তিহীন সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে মুখ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও অন্যদের উপর ‘পূর্ব-পরিকল্পিত’ হামলা হয়েছে। কারাটের যুক্তি, “বাস্তবে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী বিনা বাধায় যোজনা কমিশনে ঢুকেছেন এবং বেরিয়ে গিয়েছেন। ঘটনার পরেই সিপিএম এর নিন্দা করেছে। কী ভাবে ওই ঘটনা ঘটল, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে সিদ্ধান্ত হয়েছে।” রাজ্যপালের বিরুদ্ধে কারাটের অভিযোগ, “একটি রাজনৈতিক দল বা তাঁর নেতারা গণতান্ত্রিক কাঠামোয় কাজ করার অধিকার হারিয়েছে বলে ঘোষণা করে দেওয়াটা সাংবিধানিক পদে বসে থাকা কোনও রাজ্যপালের পক্ষে অনুচিত।” কারাটের যুক্তি, রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি। তাই রাষ্ট্রপতিরই উচিত রাজ্যপালকে এ বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দেওয়া।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.