সমালোচনায় বাম শরিকরাও
হাসপাতালে মমতা, জখম সিপিএম
শ্বাসকষ্ট এবং ঘাড়-কনুই-কোমরে ব্যথা নিয়ে বুধবার দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চিকিৎসকেরা তাঁকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। মঙ্গলবার যোজনা কমিশনের দফতরের সামনে বিক্ষোভরত এসএফআই কর্মীদের ধাক্কাধাক্কির ফলেই মমতা চোট পেয়েছেন বলে দাবি তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের।
ঘটনা হল, শুধু মমতা নন, সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যুর প্রতিবাদে যে আন্দোলন, তাকে দিল্লি টেনে নিয়ে গিয়ে এসএফআই নেতারা জোর ধাক্কা দিয়েছেন নিজেদের দল সিপিএম-কেও। এই ঘটনার জেরে এক দিকে যেমন সম্প্রতি তৈরি হওয়া সহানুভূতির বাতাবরণ খুইয়েছে সিপিএম, তেমনই জেলায় জেলায় দলীয় কর্মীদের উপরে আক্রমণ তাদের আরও কোণঠাসা করে দিয়েছে। বস্তুত, দিল্লি-কাণ্ড এক ধাক্কায় তাঁদের অনেকটাই পিছিয়ে দিল বলে বুধবার কবুল করে নিয়েছেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু নিজেই। শুধু তা-ই নয়, দিল্লির ঘটনার দায় কার, রাজ্যের এসএফআই নেতাদের না দিল্লির সিপিএম নেতাদের তা নিয়ে চাপানউতোর সিপিএমের বাংলা-দিল্লি বিভাজনকেও আরও এক বার প্রকট করে দিয়েছে।
বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে ছন্নছাড়া হয়ে পড়া বাম শিবির পঞ্চায়েত ভোটের মুখে ফের ঘর গোছানোর চেষ্টা করছিল। বাম নেতারা অনেকেই বলছিলেন, জনগণের আস্থা ফিরে পাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি না-হলেও সম্প্রতি নানা ঘটনায় তৃণমূল সরকারের প্রতি মানুষের যে বিরূপ মনোভাব দেখা যাচ্ছে, তাকে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছিল সিপিএম। পুলিশ হেফাজতে সুদীপ্তর মতো তরতাজা এক তরুণের মৃত্যুর পরে সহানুভূতির একটা হাওয়া উঠেছিল বলেও সিপিএম নেতাদের অনেকের দাবি। কিন্তু দিল্লির ঘটনা তৃণমূলকে যেমন অক্সিজেন দিল, তেমনই পায়ের তলার মাটি কাড়ল সিপিএমের। শুধু তা-ই নয়, বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়ল তারা।
বুধবার আলিমুদ্দিনে এক প্রশ্নের জবাবে বিমানবাবু বলেন, “সাময়িক ভাবে সত্যিই কিছু অসুবিধা হল। আবার আমাদের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁদের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে হবে।” আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদক ক্ষিতি গোস্বামী, সিপিআইয়ের মঞ্জুকুমার মজুমদার, ফরওয়ার্ড ব্লকের হাফিজ আলম সৈরানিও মনে করেন, ওই ঘটনা এক ধাক্কায় বামেদের অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে। এ দিন বামফ্রন্টের জরুরি বৈঠকে তাঁরা সে কথা বলতেও ছাড়েননি। এক ঘণ্টা ধরে শরিকদের সমালোচনা মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন বিমানবাবু।
দিল্লির ঘটনার পরে যে ভাবে জেলায় জেলায় সিপিএম পার্টি অফিস আক্রান্ত হচ্ছে, তাতেই প্রমাদ গুনছেন দলীয় নেতারা। বিধানসভা নির্বাচনের পরেও যে এত পার্টি অফিস আক্রান্ত হয়নি, জেলার প্রথম সারির নেতারা এত আক্রমণের মুখে পড়েননি, এত সংখ্যায় সিপিএম কর্মীদের ঘরছাড়া হতে হয়নি তা বিমানবাবুও মেনে নিয়েছেন। এ বার তৃণমূলের আক্রমণের হাত থেকে বাদ পড়েনি ফব, সিপিআই, আরএসপি-ও। ফলে পঞ্চায়েত ভোটের আগে নিচু তলায় সংগঠন মেরামতের যেটুকু কাজ বামফ্রন্ট করে উঠতে পেরেছিল, বহু জায়গাতেই তা বেশ কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেল।
সিপিএম-সহ বাম নেতারা বলছেন, রাজ্যের অধিকাংশ পার্টি অফিস যখন ফের কাজ করতে শুরু করেছিল, পার্টি অফিসে আবার নিয়মিত লোকজন আসছিলেন, তখন তৃণমূলের এই আক্রমণ মানুষকে ভয় পাইয়ে দিল। বামেদের পার্টি অফিসে আসতে লোকেরা ভয় পাবেন। পঞ্চায়েত ভোটের আগে বিভিন্ন স্তরে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার চেষ্টাও ধাক্কা খাবে। বহু জায়গাতেই বুথ কমিটি গড়া যাবে না। অনেকেই প্রার্থী হতে ভয় পাবেন। বিমানবাবু অবশ্য প্রকাশ্যে আশা প্রকাশ করছেন যে, তৃণমূলের এই তাণ্ডবের জবাব সাধারণ মানুষ দেবেন। তাঁর কথায়, “দিল্লির ঘটনা যে আমরা সমর্থন করি না, বার বার তা জানানোর পরেও যে ভাবে পার্টি অফিস আক্রান্ত হচ্ছে, তাতে মানুষকে নতুন করে ভাবতে হবে।”
তবে তৃণমূলের আক্রমণের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্র থেকেও চাপ কোণঠাসা করছে সিপিএম-কে। রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন এ দিনই বিবৃতি দিয়ে দিল্লির ঘটনাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ বলেছেন। এর জন্য পলিটব্যুরোর ক্ষমা চাওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মহাশ্বেতা দেবী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অর্পিতা ঘোষ-সহ এক ঝাঁক বিশিষ্ট জন ও টলিউড শিল্পীরা বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘সংশয় জাগে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই কি সিপিএম এবং তার শাখা সংগঠনগুলি এই নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে?’
রাজ্যপালের বক্তব্য অবশ্য খারিজ করে দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। তাঁর কথায়, “রাজ্যপাল এই ঘটনাকে পূর্বপরিকল্পিত বলতে পারেন। তিনি ঝানু পুলিশ অফিসার।” পলিটব্যুরোর ক্ষমা চাওয়ার দাবি প্রসঙ্গে বিমানবাবুর মন্তব্য, “রাজ্যপাল জানেন না, পলিটব্যুরো কী। ...পলিটব্যুরোর পক্ষ থেকে আজ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। গত কাল আমি, বুদ্ধ, সূর্যকান্ত তিন জন পলিটব্যুরো সদস্য এ ব্যাপারে ক্ষমা চেয়েছি।” বিমানবাবুর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাল্টা বলেছেন, “কিছু দিন আগেও যাঁরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় রাজ্যপালের দ্বারস্থ হতেন, আজ রাজ্যপাল সত্যি কথাটা বলায় তাঁরাই নগ্ন ভাবে তাঁকে আক্রমণ করছেন!”
এই প্রতিকূল অবস্থায় সিপিএম-কে স্বস্তি দিচ্ছে না বাম শরিকরাও। তাদের মতে, ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েও সিপিএম এক তরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তার দায়ভার গোটা বামফ্রন্টকে নিতে হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে শরিক নেতারা বলেন, কলকাতায় এসএফআইয়ের আইন অমান্যের সিদ্ধান্ত কার্যত অন্য শরিক ছাত্র সংগঠনগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মঙ্গলবার এক তরফা ভাবে এসএফআই এবং দিল্লির সিপিএম ইউনিট অমিতবাবুকে হেনস্থা করেছে। সৈরানি বলেন, ঘটনার দায় সিপিএম-কেই নিতে হবে। ক্ষিতিবাবু প্রস্তাব দেন, ভাবমূর্তি ফেরাতে অমিতবাবুর সুস্থতা কামনা করে এবং হেনস্থার ঘটনায় ক্ষমা চেয়ে তাঁকে চিঠি দিন বিমানবাবু। অভিযুক্ত এসএফআই নেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শতরূপ ঘোষের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সে প্রশ্নও ওঠে।
বৈঠকের পরে বিমানবাবু বলেন, ভবিষ্যতে বামফ্রন্টের সব শরিককে জানিয়েই কর্মসূচি নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে প্ররোচনা সৃষ্টি না-করা এবং প্ররোচনায় পা না-দেওয়ার আবেদন জানান তিনি। দ্রুত পঞ্চায়েত ভোট করার দাবিতে বিভিন্ন জেলায় কনভেনশন, মিছিল এবং আইন অমান্য আন্দোলন করার সিদ্ধান্তও হয়েছে। তবে ওই সবই করা হবে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে।
তৃণমূলের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়াই এখন প্রথম কাজ বলে বাম নেতারা মনে করছেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.