পাসপোর্ট নেই। ভিসাও না। দূরত্ব শুধু একটা নদীর। কিছু নগদ পয়সা, সীমান্ত রক্ষীর পকেটে ফেলে দিলেই পেরিয়ে আসা যায় নিজের দেশ, ভূমি পরিবার। কিন্তু ফেরা? ‘কাজে’র নামে পাচার হওয়া মেয়েদের ঘরে ফেরার লড়াইটা একান্তভাবেই তাদের একার।
লড়াই শুধু দালাল বা যৌনপল্লির নাছোড় ফেউদের সঙ্গে নয়, লড়াইটা দুই রাষ্ট্রের নানা দফতরের সঙ্গেও। নিজের ক্রোধ, অবসাদ, অধীরতার সঙ্গে। সেই কথাই বলছিলেন আফসানা আর কনক (নাম পরিবর্তিত)। কলকাতায় একটি আলোচনা সভায় তাঁরা বলেন, “আসার সময় দালালের হাতে কয়েকটা টাকা দিয়ে দশ মিনিটেই বর্ডার পেরিয়ে গিয়েছি। ফিরে যেতে এত দিন কেটে গেল কেন?”
বাংলাদেশ থেকে যে মেয়েরা বেআইনি ভাবে এসে ঢোকেন এ দেশে, তাঁদের ঘরে ফেরানোর সমস্যা অনেক। ‘জবালা’ সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনের প্রতিনিধি, ভারতের গোয়েন্দা পুলিশ, বিএসএফ, সমাজ কল্যাণ দফতর, মহিলা কমিশন, পাচার সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের সদস্য এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। কী করে লাল ফিতের ফাঁস থেকে মুক্তি দিয়ে দেশে ফিরিয়ে দেওয়া যায় আফসানা, কনকের মতো মেয়েদের, তার উপায় খোঁজাই ছিল উদ্দেশ্য।
কথাবার্তায় স্পষ্ট হল, কত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি মেয়ে অবৈধভাবে আসেন ভারতে। প্রতি মাসে কেবল ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ (‘রিপ্যাট্রিয়েশন অর্ডার’) আসে অন্তত একশো মেয়ের, জানালেন বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি শেখ শরীফ উদ্দিন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির অভিজ্ঞতা, মুম্বই, পুনে, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, মহীশূরের মতো শহরগুলির যৌনপল্লি থেকে প্রতিবার পুলিশ হানায় অন্তত দু-তিনজন বাংলাদেশি মেয়ে উদ্ধার হয়। এরা অধিকাংশই কাজের খোঁজে কোনও দালালকে টাকা দিয়ে ঢুকেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কোনও সীমান্ত পেরিয়ে। তারপর ট্রেনে দীর্ঘ যাত্রার পরে ওই দালালরাই তাদের যৌনপল্লিতে পৌঁছে দেয়। সেখানে ওই মেয়েরা না বোঝেন হিন্দি, কন্নড় বা মরাঠি ভাষা, না পারেন দালাল বা খদ্দেরদের সঙ্গে কোনও দরদস্তুর করতে। কার্যত বন্দিদশায় দিন কাটে তাঁদের।
কিন্তু উদ্ধারের পরে শুরু হয় আর এক দুঃস্বপ্ন। ভিনরাজ্যের পুলিশ তাদের নিয়ে গিয়ে তোলে কোনও একটা হোমে। প্রায়ই বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় খোঁজখবর দ্রুত করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পুলিশ এই মেয়েদের থেকেই দশ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়। এই মেয়েদের শেখানো হয়, জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তাঁরা যেন নিজেদের পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বলেন। তাহলেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবেন তাঁরা। “হোমে দেখলাম, এক একজন পাঁচ-সাত বছরও রয়েছে সেখানে। তাই আমরা মিথ্যে করে পশ্চিমবঙ্গের ঠিকানা দিয়েছিলাম,” অকপটে বললেন আফসানা। যদিও যে কোনও রাজ্য থেকেই সরাসরি বাংলাদেশে পাঠানো নিয়ম, তবু মহারাষ্ট্রের পুলিশ প্রায়ই খোঁজখবর না করেই আদালতের নির্দেশ-সহ বাংলাদেশি মেয়েদের পাঠিয়ে দেয় পশ্চিমবঙ্গের হোমগুলোতে।
সীমান্ত পেরোলেই বাড়ি ফেরা যাবে, সেই আশায় মেয়েরা ফেরে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু তারপর শুরু হয় এক দীর্ঘ প্রতীক্ষা। ‘জবালা’-র কর্ণধার বৈতালী গঙ্গোপাধ্যায় জানান, ঘরে ফেরানোর প্রক্রিয়াটিতে ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে অন্তত ১৬ থেকে ১৭টা দফতর যুক্ত থাকে। অথচ তাদের মধ্যে সমন্বয়ের চূড়ান্ত অভাব। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র পাঠাতে দেরি করে। তার পরে এ দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে বাংলাদেশে ফেরানোর অনুমতিপত্র দেওয়া হয় বিএসএফের প্রধান দফতরে। তাঁরা আবার যোগাযোগ করতে হয় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিডিআর-এর সঙ্গে। যারা নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে এই মেয়েদের বাড়ি পৌঁছিয়ে দেন, তাঁদের সুবিধা মতো দিন পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
ততদিনে বন্দি জীবন সহ্য করতে না পেরে পালানোর চেষ্টা করেন আফসানারা। আফসানা বলেন, “অনেক সময়ে আমরা হোমের দিদিদের মারি। বাথরুমে বন্ধ করে রাখি। আসলে আর পারি না। কবে বাড়ি ফিরব?”
এর সমাধান কী? সম্প্রতি রাজ্য সরকারের উদ্যোগে তৈরি হোম মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান অশোকেন্দু সেনগুপ্ত জানান, যৌনপল্লির জীবনের পর হোমের একঘেয়ে পরিবেশে দিনের পর দিন থাকা তাঁদের পক্ষে কষ্টকর। সেই সঙ্গে বাড়িতে টাকা পাঠানোর তাগিদ তো থাকেই। আফসানারা জানান, হোমে মেয়েদের যা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে তা আর কোনও কাজে লাগে না। আর এখান থেকে উপার্জনের অর্থও বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া বেআইনি। কী করবেন তাঁরা? সব চেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি হয়, যখন কোনও মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। শিশুর নাগরিকত্ব নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। শিশুকে নিয়ে বাংলাদেশি মায়ের নিজের দেশে ফেরাটা আরও একটা লড়াই।
আলোচনায় বেরিয়ে আসে, লাল ফিতের ফাঁস কাটতে হলে কলকাতা থেকে দিল্লির মাধ্যমে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের নিয়ম এড়িয়ে যদি সরাসরি সংযোগের ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে পুনর্বাসনের সময় লাগবে অনেক কম। এ ছাড়াও মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক প্রভৃতি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে না পাঠিয়ে আইন মেনে সরাসরি বাংলাদেশে পুনর্বাসন করলেও মেয়েদের প্রতীক্ষা কমে। আর সর্বোপরি, অবৈধ অনুপ্রবেশ রুখতে সতর্ক হতে হবে দুই দেশেরই সীমান্তরক্ষীদের। শরীফ উদ্দিন বলেন, “কোনও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই এত মেয়ে যে কাজের খোঁজে আসছেন ভারতে, সে তো আমাদেরও লজ্জা। কেন এমন হবে? সীমান্তেই এঁদের আটকানো দরকার।” |