|
|
|
|
তারাবাজি |
নৈঃশব্দ্যের শব্দ
কোনও সুর ছাড়াই যে বিরল সঙ্গীত সৃষ্টি হতে পারে তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে রইল ‘শব্দ’।
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। লিখছেন এই ছবির সম্পাদক মৈনাক ভৌমিক |
“সিনেমা সিনেমা সিনেমা আজ, সিনেমার বড়দিন
শ্যুটিং শুরু কলকাতায় বম্বের হিরোইন
নির্দেশকের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এমন ছবি বানাবে
সারা দেশ জুড়ে সক্কলে একসঙ্গে ‘তারা’ হয়ে যাবে
সুস্থ চিন্তা ভাবনা নিয়ে কমার্শিয়াল কেতায়
এমন ছবি সম্ভব একমাত্র কলকাতায়
প্রযোজক শুধু একটা কথাই বার বার বলে যান
একটা দুষ্টু গান ঢোকান, দুষ্টু গান ঢোকান
একটা দুষ্টু গান ঢোকালে
দেখিয়ে দেব সব্বাইকে ভাল ছবিটাও চলে...”
সিনেমা আর গানের যে কী নিবিড় সম্পর্ক তারই প্রকাশ অঞ্জন দত্তের এই গান।
সত্যিই তো তাই! গান ছাড়া ছবি হয় না।
রবিশঙ্করের সেতার কিংবা তারসানাইয়ের সুর ছাড়া কি ‘পথের পাঁচালী’ ভাবা যায়?
ভাবা কি যায় এ আর রহমানের সুর ছাড়া ‘বম্বে’ সিনেমাটা?
সেই সুরের মূর্ছনা এমনই যে পলকের মধ্যে দর্শককে দক্ষিণ ভারতের এক প্রত্যন্ত সুন্দর গ্রাম থেকে ভাসিয়ে নিয়ে আছড়ে ফেলে মুম্বই দাঙ্গার নির্মম বাস্তবতায়।
হাল আমলে দেবজ্যোতি মিশ্রর সুর ছাড়া ভাবাই যায় না ‘অটোগ্রাফ’এর মতো ছবি। সে ছবির গান তো মুখে মুখে ফিরেছে।
ভারতীয়রা গান আর সুরের মায়াজাল ছাড়া সিনেমার কথা ভাবতেই পারেন না।
আমাদের ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রত্যেকটা সিনেমাকেই তো এক একটা মিউজিক্যাল বলা চলে। চার থেকে ছ’টা গান তো এক একটা সিনেমায় থাকেই। একটা সিনেমার বিপণন পরিকল্পনার সঙ্গে মিউজিক অ্যালবামের রিলিজ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে।
বিশ শতকের হলিউডকে কিছু সেরা সঙ্গীত উপহার দিয়েছিলেন জন উইলিয়ামস, এন্নিও মরিকন, অ্যান্তন কারাস-এর মতো সুরকারেরা। বার্নার্ড হেরম্যানের ভায়োলেন্ট ভায়োলিনের বাজনা ছাড়া যেমন ‘সাইকো’ সিনেমার সেই সুবিখ্যাত শাওয়ার সিন-কে কল্পনা করা যায় না, তেমনই জন উইলিয়ামস-এর বাজনা ছাড়া ‘জস’ সিনেমার সেই হাঙরও অত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারত না। |
‘শব্দ’ ছবির একটি দৃশ্যে ঋত্বিক চক্রবর্তী |
বিশ্বজুড়ে সিনেমাকরিয়েরা (সে বাণিজ্যিক সিনেমা হোক, অথবা আর্ট ফিল্ম বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা) যখন এ ভাবে গানের জোরদার ক্ষমতার উপর নির্ভর করছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘শব্দ’ সত্যিই ব্যতিক্রম। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বলা যায় এটি একটি আইকনিক সিনেমা, যেখানে বাকিদের মতো গানের কোনও প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকছে না। এতটুকুও গানের সাহায্য ছাড়া এই পরিচালক কেবলমাত্র শব্দ নিয়ে একটা আস্ত সিনেমা তৈরি করে ফেললেন। এ ব্যাপারে তাঁর উদ্যম এবং সাহসিকতা সত্যিই প্রশংসনীয়। সিনেমায় যে কবিতা এবং ছন্দ নিহিত থাকে, তাকেই যেন এক শব্দহীন ঝঙ্কারে উত্তরণ ঘটিয়েছে ‘শব্দ’ ছবির নিরুচ্চার মিউজিক্যাল সিম্ফনি।
‘শব্দ’-তে ব্যক্তিগত কাজের অভিজ্ঞতার খাতিরে বলছি, এত আনন্দ আমি বোধহয় আর অন্য কোনও ছবি করে পাইনি। সুর-লয়-গান ছাড়া একটা সিনেমাকে চালানোটা সত্যিই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল আমার কাছে। আর্ট ফিল্মের দুনিয়ায় সাড়া জাগানো সব সিনেমা যেমন হারমনি কোরিনের ‘জুলিয়েন ডাঙ্কি বয়’ (ড্যানিশ সিনেমা তৈরির ম্যানিফেস্টো ডগমে ৯৫ অনুসরণে তৈরি প্রথম আমেরিকান সিনেমা যাতে মিউজিক প্রায় ছিলই না) দেখে বেড়ে ওঠা এই মুভি বাফ আমি যে মুহূর্তে ‘শব্দ’ দেখলাম, তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, চোখের সামনে একটা লেজেন্ডারি মুহূর্ত তৈরি হতে দেখছি।
সিনেমাটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এক পেশাদার ফলি আর্টিস্টকে নিয়ে, যার কাজ হল সিনেমায় সাউন্ড এফেক্টস আবহ তৈরি করা। প্রাত্যহিক জীবনে কানে শোনা যায়, এমন সব শব্দ তৈরি করাই এই শিল্পীর কাজ। যেমন বিন্দু বিন্দু জল পড়ার শব্দ, এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ, পাতা মচমচ করার শব্দ। এই ভাবে চলতে চলতে বাস্তবের বোধটাই হারিয়ে যায় এই শিল্পীর। সে যখন স্টুডিয়োর বাইরে দৈনন্দিন জীবনে তার পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থাকে, তখনও কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, গুরুত্বহীন সেই সব শব্দই শুনতে পায়, যেগুলোকে বাকিরা সে ভাবে পাত্তাই দেয় না।
অন্য দিকে যে শব্দগুলো সবাই সাধারণ ভাবে শুনতে চায়, যেমন ভালবাসার মানুষের আদুরে কথা সেগুলো তার কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। সোজা ভাবে বলতে গেলে ওর বাস্তববোধটাই পুরোপুরি বদলে যায়। নিজের মনগড়া কাল্পনিক এক জগতের বাসিন্দা হয়ে পড়ে সে। আর শুনতে পায় শুধু সেই সব শব্দ, যা অন্যরা কেউ শুনতে পায় না।
ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘সিলভার পিকক’ জয়ী এই পরিচালকের সিনেমা ‘জাস্ট অ্যানাদার লভ স্টোরি’, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আর লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও স্ট্যান্ডিং ওভেশন পেয়েছিল।
কৌশিকদা পরিচালিত সিনেমা ‘শব্দ’ আবারও এক বার আমাদের দেশকে গর্বিত করল। নিঃসন্দেহে বিশ্বচলচ্চিত্রে এ এক বিরাট মাপের অবদান। কৌশিকদা, ‘শব্দ’ টিমের সব্বাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই, এ রকম একটা প্রজেক্টের অংশ হতে পেরেছি বলে।
কৌশিকদা, তোমার সঙ্গে কাজ করে তোমার প্রতিভার পাঁচ শতাংশ পেলেও নিজেকে ধন্য মনে করতাম। |
|
|
|
|
|