হুল্লোড়
আমাকে আর মোটা বোলো না
দলে গিয়েছে তাঁর পুরো জীবনটাই।
এত ভাল অভিনেত্রী, কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে যখনই কথা হয়েছে তাঁকে অসম্ভব ভীত, সন্ত্রস্ত আর ভালনারেবল লেগেছে।
সোমবার সকালে অবশ্য কলকাতা রোয়িং ক্লাবের জিমে দেখলাম নিজেকে কতটা বদলে ফেলেছেন তিনি।
সোহিনী সেনগুপ্ত। আগে ছিলেন ১১৭ কেজি। আজকে ৯৬। লক্ষ্য ৭৫।

কাঁদতাম বসে একা একা
“জানেন সোহিনী ইতিমধ্যেই ২০ কিলো কমিয়ে ফেলেছে। আমার পরের ছবি এক জন ওয়েট লিফ্টারকে নিয়ে। আমি সোহিনীকে রাজি করিয়েছি। তার জন্য ওকে ৭৫ কেজি হতেই হবে। এসে দেখে যান সিআরসি-তে কী পরিশ্রমটাই না করছে,” গত শনিবার দুপুরে ফোনের ও পার থেকে হঠাৎ বলেন ‘ইচ্ছে’ আর ‘মুক্তধারা’র পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
ভেবেছিলাম গিয়ে একটা নতুন ছবির ‘নিউজ’ পাব। কিন্তু কই, নিউজ তো জাস্ট ‘ইনসিডেন্টাল’। পেলাম এক জন মানুষের নিজের সম্বন্ধে বিতৃষ্ণা, ঘৃণা, ভয় কাটানোর অক্লান্ত পরিশ্রমের কাহিনি।
“আমি মোটা হতে হতে এমন একটা স্টেজে পৌঁছে গিয়েছিলাম, যে নিজেকে নিজেই ঘেন্না করতাম, জানেন? কাঁদতাম ঘরে একা একা,” ওয়েট ট্রেনিং শেষ করে বলছিলেন সোহিনী। ছলছলে চোখে। ধীরে ধীরে সেই সব ভয়াবহ দিনের কথা বলতে শুরু করেন সোহিনী।

শরীরটাই তো আউট অফ শেপ হয়ে গেল
“মানুষ যখন মোটা হতে শুরু করে সে নিজের সেল্ফ ডিফেন্স নিজেই বানায়। মোটা মানুষেরা প্রায়ই বলেন দেখবেন, ‘একটাই তো জীবন, না খেয়ে মরে যাওয়াটা আবার কাজের কথা নাকি।’ এ সব বলার সময় তাঁরা হাসেনও খুব। কিন্তু কেউ জানে না এটা বলার সময় তাদের ভিতরটা হু হু করে।
ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের জিমে সোহিনী সেনগুপ্ত
তারাও রোগা হতে চায়। নিজেদের পুরনো ছবি দেখে তাদের খুব মন খারাপ হয়,” এক মনে বলছিলেন রুদ্রপ্রসাদ আর স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর কন্যা।
কথায় কথায় জানতে পারলাম ক্লাস নাইন পর্যন্ত ভরতনাট্যম শিখতেন সোহিনী। কিন্তু তার পর আর কন্টিনিউ করতে পারেননি। “করব কী করে? তার উপর পুরো শরীরটাই আউট অফ শেপ হয়ে গেল,” বলেন তিনি।

মোটা মানুষেরা নিজেদের বোকা বানায়
শোনাচ্ছিলেন তাঁর দুঃখের কথা। বললেন, প্রায় কুড়ি বছর ধরে ওজন বাড়তে বাড়তে এমন একটা স্টেজে গিয়েছিল যে নড়াচড়া করতেই কষ্ট হত তাঁর। “নিশ্বাস নিতে কষ্ট হত, রাতে অসম্ভব নাক ডাকতাম। খালি মনে হত মা-বাবা এক বার চলে গেলে আমার কী হবে! ছবি তুললে পালিয়ে যেতাম। মাটিতে বসতে পারতাম না। আর নিজেকে বোকা বানাতাম। লোকের সামনে অভিনয় করতাম আমি কতটা ফিট সেটা বোঝানোর জন্য,” বলেন সোহিনী।
কথা বলতে বলতেই বোঝা যায় যন্ত্রণাটা কতটা গভীর। “আসলে মোটা হলে শারীরিক কষ্ট তো আছেই, কিন্তু সব চেয়ে বেশি কষ্ট হল আপনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাবেন। হীনমন্যতায় ভুগবেন যেমন আমি ভুগতাম। সর্বক্ষণ। মাই কনফিডেন্স ওয়াজ শ্যাটারড,” বলতে বলতে মুখ নামিয়ে ফেলেন তিনি। কথাটা শুনে আড়চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখেন তাঁর ট্রেনার।

ওয়েট লিফ্টারের রোল করতে হবে আমায়
এই রকম মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হতে হতেই এক দিন এই ছবির অফার আসে। “ছবিটা এক জন ওয়েট লিফ্টারের কাহিনি নিয়ে। পরিচালনা করছেন শিবু আর নন্দিতা রায়। ওরাই আমাকে জোর করেন এই ছবিটা করতে,” তোয়ালে ব্যাগে ভরতে ভরতে বলেন তিনি। এই ছবির জন্য সোহিনীকে ট্রেনিং করাচ্ছেন রণদীপ মৈত্র। ছবিতে ওয়েট লিফ্টারের জীবনের খুঁটিনাটির ব্যাপারে অ্যাডভাইজার হিসেবে থাকছেন অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়। ফিল্মটি প্রযোজনা করছেন অতনু রায়চৌধুরী।
“ছবি শুরু হবে অক্টোবর মাসে। তার কারণ সোহিনীর আরও একটু সময় লাগবে ওজন কমাতে। দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসের সময় যে ভেন্যুতে ওয়েট লিফ্টিং কম্পিটিশন হয়েছিল, আমরা সেখানে শু্যটিং করব। সেই সব পারমিশনের চেষ্টা চলছে। সোহিনীও অসম্ভব পরিশ্রম করছে। প্রথম যে দিন জিমে এসেছিল ওর তো হাঁটতেও কষ্ট হত। আমরা সবাই ভেবেছিলাম পারবে না। কিন্তু করে দেখাল বটে,” হেসে বলেন শিবপ্রসাদ।

আমি ভয়টা জয় করেছি। আপনারাও পারবেন
কথায় কথায় সোহিনী ফিরে যান তাঁর অতীতে। “ডিপ্রেশন হলেই খাবার অর্ডার করতাম। বিরিয়ানি, রোল, কোল্ড ড্রিংক্স কিছুই বাদ যেত না। ওই খাবার সময়টুকু শুধু এনজয় করতাম। ওটাই ছিল এন্টারটেনমেন্ট। রাতে ফ্রিজ খুলে মিষ্টি খুঁজতাম। আজকে অবশ্য আর ও সব করি না। এই সিনেমার জন্য আমি রোগা হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু আসল কথা আমি আবার নতুন করে বাঁচার রসদ পাচ্ছি। আই অ্যাম ফিলিং হ্যাপি,” বেশ কনফিডেন্টলি বলেন সোহিনী সেনগুপ্ত, যাকে টালিগঞ্জের অনেকেই মনে করেন এই সময়ের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। এ বার জিম ছেড়ে যাওয়ার পালা।
যেতে যেতে সোহিনী বলেন, “আমাকে রাস্তাঘাটে অনেক মোটা মানুষ এসে বলেন, ‘জানেন আপনাকে দেখে আমাদের কী ভাল লাগে! আপনি কী রকম নিজের ওয়েট নিয়ে কনশাস নন। এ রকম ক’জন পারে! ইউ ইন্সপায়ার আস।’ ওদের কথা শুনে আমি হাসতাম কিন্তু একদম ভাল লাগত না সেই কথাগুলো শুনতে। তাদের হয়তো সেই মোটা সোহিনীকে দেখে ভাল লাগত, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার ভাল লাগত না। আই হেটেড দ্যাট ফ্যাট সোহিনী। কিন্তু আমার উপায় ছিল না। আমি রোগা হতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। হাল ছাড়াটা লোকেরা ভাবত আমার বীরত্ব। কিন্তু আজকে কোনও অপারেশন ছাড়া এতটা ওজন কমিয়ে আমার জীবনটাই বদলে যাচ্ছে। আজকে মা-বাবা খুশি। শুধু এটা ভেবে ডিলে করবেন না যে প্রথম দিন জিমে আমাকে দেখে লোকে হাসবে, তাই ওখানে গিয়ে লাভ নেই। আমি ওই ভয়টাকে জয় করেছি। কোনও ব্যাপারই না সেটা। শুধু এটুকুই বলব আমি যদি ওজন কমাতে পারি, তা হলে আপনারাও সবাই পারবেন।”
এই প্রথম তাঁকে খুব আত্মবিশ্বাসী শোনায়। ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠে পড়েন সোহিনী।
তাঁকে দেখতে দেখতে মনে হয়, ‘ইচ্ছে’র সেই জাঁদরেল মা, যাকে আমরা কেউই পছন্দ করিনি, সে নিজেই যে আজকে বহু মানুষের কাছে ওজন কমানোর অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। এটাই তো আসল ‘স্টোরি’। সত্যি বদলে গিয়েছেন সোহিনী সেনগুপ্ত। ১১৭ কিলো থেকে ৯৬। লক্ষ্য ৭৫।

কী খেতাম
• ব্রেকফাস্ট একেবারেই খেতাম না।
• দিনের প্রথম খাবার খেতাম দুপুর বারোটা নাগাদ। মেনুতে থাকত হোয়াইট ব্রেড, ডিম। কখনও রুটি তরকারি।
• সারা সন্ধে খালি পেট থাকতাম। খেলেও রোল আর কোল্ড ড্রিংক্স।
• রাত দেড়টা নাগাদ ভাত, ডাল, চিকেন কী মাছ দিয়ে পেট ভরে ডিনার।
কী খাই
• সাড়ে পাঁচটায় মর্নিং ওয়াক করে গ্রিন-টি আর কাঠবাদাম। তার পর সাতটা থেকে দেড় ঘণ্টা জিমে কার্ডিও, ওয়েট লিফ্টিং আর সার্কিট ট্রেনিং।
• জিম শেষ করে টক দই আর ওটস। সকাল এগারোটায় ফল। লাঞ্চে ভাত, রুটি একেবারেই নয়। শুধু সব্জি আর চিকেন।
• সন্ধে সাতটায় টমেটো স্যুপ।
• রাত সাড়ে ন’টায় চিকেন আর সব্জি। তার কিছু ক্ষণ পরেই ঘুম।
১১৭-র জীবন
• আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মেলামেশা করতে ভাল লাগত না।
• কনফিডেন্স ছিল জিরো।
• নাটকের সময় যাতে লোকে না বোঝে আমার এনার্জি কম, তাই বেশি বেশি করে এফর্ট দিতাম।
• এক্সট্রিম মুড স্যুইংস হত। তার জন্য জীবনে ভুল ডিসিশনও নিয়েছি।
• খালি ভয় লাগত। মা-বাবা চলে গেলে আমি বাঁচব কী করে এই চিন্তা করতাম সারা দিন।
• সব সময় কাউকে না কাউকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করতাম। তারা নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকলে মনে হত তারা অ্যাভয়েড করছে। অসম্ভব পজেসিভ হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
• সব সময় বিরিয়ানি, বাইরের খাবার খেতাম। ওই সময়টুকুই একটা অদ্ভুত আনন্দ পেতাম।
• কেউ ছবি তুললে কনশাস হয়ে উঠতাম। ভাবতাম কখন পালাব সেখান থেকে।
• শরীরে মোবিলিটি ছিল না।
• সব কাজ অ্যাভয়েড করতাম। কোনও কাজ করতে হবে জানলেই প্রথম রিঅ্যাকশন হত, ‘নট টুডে, কাল যাব’।
৯৬-এর জীবন
• অনেক হাসিখুশি লাগে।
• ভয় করে না অত বেশি। ভয় হলেও মনে হয় এটা কেউ যদি কাটাতে পারে তো আমি নিজে।
• পজেসিভনেসটা কমে গিয়েছে।
• সিঁড়ি ওঠার সময় শিরদাঁড়াটা সোজা থাকে আজকে।
• আর নাক ডাকি না আমি।

ছবি: কৌশিক সরকার



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.