আদালতের কাজের সময় শেষ হয়ে যায় বিকেল সাড়ে চারটেয়। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে রাজ্য নির্বাচন কমিশন বনাম রাজ্য সরকারের মামলার শুনানি তখনই শেষ হবে না। চলবে আরও দেড় ঘণ্টা।
অন্তত মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্ট এমনই স্থির করেছে। আদালত ছুটির পরেও মামলা শোনার সিদ্ধান্তকে অনেকটা নজিরবিহীন হিসেবেই দেখছেন আইনজীবী মহলের একাংশ। যার ব্যাখ্যা হিসেবে হাইকোর্টের প্রাথমিক ও অন্যতম দায়িত্ব, অর্থাৎ অ্যাপিলেট সাইডের মামলার নিষ্পত্তির তাগিদের কথাই বলেছেন সংশ্লিষ্ট বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার। উল্লেখ্য, পঞ্চায়েত-মামলাটি অরিজিন্যাল সাইডের।
বিচারপতি সমাদ্দার প্রথমে ঠিক করেছিলেন, রাজ্য বনাম কমিশনের মামলাটি তিনি শুনবেন প্রতি মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটে থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত। কমিশনের কৌঁসুলি সমরাদিত্য পালের আর্জি ছিল, মামলার গুরুত্ব বিবেচনা করে সপ্তাহে পাঁচ দিনই শুনানি চলুক। এই মর্মে সোমবার সমরাদিত্যবাবুর পেশ করা আর্জিটি এ দিন আংশিক ভাবে মেনে নিয়ে বিচারপতি বলেন, তিনি মামলাটি সপ্তাহের ওই দু’দিনই (মঙ্গল-বৃহস্পতিবার) শুনবেন, তবে শুনানি হবে বিকেল তিনটে থেকে সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত। অর্থাৎ, ওই দু’দিন কোর্ট ছুটির পরে বাড়তি দেড় ঘণ্টা পঞ্চায়েত-শুনানির জন্য বরাদ্দ করা হল।
কলকাতা হাইকোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র আদালতের ‘কর্মসংস্কৃতি’ ফেরাতে বার বার সরব হয়েছেন। তবু আইনজীবীদের একাংশের ছুটি নেওয়ার অভ্যেস তিনি বদলাতে পারেননি। নানা কারণে কাজ বন্ধের রেওয়াজ এখনও মাঝে-মধ্যে মাথা চাড়া দেয় হাইকোর্টে। এই পরিস্থিতিতে এ দিন বিচারপতি সমাদ্দারের সিদ্ধান্তে রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটে পেরনোর পরেও কিছুক্ষণ শুনানি চলল সাম্প্রতিক অতীতে কলকাতা হাইকোর্টে এমন ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। তবে একেবারে ঘড়ি ধরে সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত কোনও মামলার শুনানি কখনও হয়ছে কি না, সে বিষয়ে হাইকোর্ট-সূত্রে কোনও তথ্য মেলেনি।
এ হেন ‘বেনজির’ সিদ্ধান্ত কেন, বিচারপতি তা ব্যাখ্যাও করেছেন। জানিয়েছেন, তাঁর এজলাসে এই মুহূর্তে হাজারের বেশি অ্যাপিলেট সাইডের মামলা রয়েছে। সেগুলি না-শুনে অরিজিন্যাল সাইডের মামলার শুনানি সম্ভব নয়। অ্যাপিলেট ও অরিজিন্যাল সাইড ব্যাপারটা আসলে কী?
আইনজীবী মহলের ব্যাখ্যা: রাজ্যের কোনও নিম্ন আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট না-হয়ে যে কোনও পক্ষ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। এই সব মামলা হল অ্যাপিলেট সাইডের। সেগুলির বিচার করা হাইকোর্টের প্রাথমিক ও মূল কর্তব্য। বস্তুত ভারতীয় আইনি জগতে হাইকোর্টের কাঙ্খিত ভূমিকা অনেকটা মুখ্যসচিবের মতো, যেখানে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের বিবাদ-বিতণ্ডার ফয়সালা চূড়ান্ত রূপ পেতে পারে। তবে কলকাতা হাইকোর্ট এর পাশে সরাসরি আসা অন্য কিছু মামলাও শোনে। সেগুলো অরিজিন্যাল সাইডের, যে ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক যোগ্যতা-সীমাও বেঁধে দেওয়া আছে। কী রকম?
ইতিহাস বলছে, উত্তরে বাগবাজার খাল, পূর্ব থেকে দক্ষিণ জুড়ে অধুনা এপিসি রোড ও এজেসি বসু রোড (অর্থাৎ সাবেক মারহাট্টা ডিচ, পরবর্তীকালের সার্কুলার রোড) এবং পশ্চিমে গঙ্গা এই চৌহদ্দির মধ্যকার অঞ্চলটিকে ব্রিটিশ আমলে বলা হত ‘ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সি’ বা খাস কলকাতা (এখন মহানগরের ১৪টি থানা-এলাকা এর অন্তর্গত)। সেই আমলের সাহেবপাড়া হিসেবে পরিচিত ওই তল্লাটে ছিল মূলত ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ও বণিকশ্রেণির বাস। সেখানকার বাসিন্দাদের আইনি বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য সরাসরি হাইকোর্টে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ দিয়েছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। তদানীন্তন মাদ্রাজ ও বোম্বে হাইকোর্টেও এ ভাবে ‘অরিজিন্যাল সাইডের’ মামলা শোনার প্রথা চালু করা হয়, কেননা কলকাতার মতো ওই দুই বন্দর-শহরেও ছিল যথেষ্ট সংখ্যক ব্রিটিশ বেনিয়া ও রাজপুরুষের বসবাস।
এবং অরিজিন্যাল সাইডের সেই ভার এখনও চেপে বসে আছে হাইকোর্টের কাঁধে। স্বাধীনোত্তর পর্বে কলকাতায় সিটি সিভিল কোর্ট ও সিটি সেশন কোর্ট চালু হওয়া সত্ত্বেও আঞ্চলিক অবস্থানের সুবাদে বেশ কিছু মামলার সামনে সরাসরি হাইকোর্টে চলে আসার সুযোগ খোলা থাকছে। তবে অরিজিন্যাল সাইডের মামলা যে হেতু সংখ্যায় কম, হাইকোর্ট তাই তার শুনানির জন্য সপ্তাহে একটি বা দু’টি দিন বেঁধে দেয়। বাকি সময়টা নির্ধারিত থাকে অ্যাপিলেট-শুনানির জন্য।
এ দিন পঞ্চায়েত-শুনানির ক্ষেত্রে ওই নির্দিষ্ট দিন দু’টি বহাল রেখে শুনানির সময় বাড়িয়েছেন বিচারপতি। পঞ্চায়েত-আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনার যাতে নির্ঘণ্ট প্রকাশ করেন, আদালতের কাছে সেই নির্দেশ চেয়ে রাজ্যের তরফে সোমবার যে আবেদন দাখিল হয়েছিল, বিচারপতি সমাদ্দার এ দিন তারও নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, মূল মামলা চলাকালীনই আদালত আবেদনটি শুনবে। আগামী শুক্রবারের মধ্যে এ ব্যাপারে রাজ্যের হলফনামা চেয়েছেন বিচারপতি। কমিশনকে তার জবাব দিতে হবে মঙ্গলবারের মধ্যে।
এ দিন শুনানির শুরুতে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় বিচারপতিকে জানান, আদালতের পরামর্শমতো সমরাদিত্যবাবুর সঙ্গে তিনি শুক্রবার একান্তে বৈঠকে বসেছিলেন, কিন্তু আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। সওয়াল শুরু করে সমরাদিত্যবাবু অভিযোগ করেন, যথাসময়ে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন আয়োজনের জন্য রাজ্যের তরফে সক্রিয়তা ও সদিচ্ছার অভাব গোড়া থেকেই। তিনি দাবি করেন, এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণের অভাব নেই।
এক সময়ে বিচারপতি তাঁকে প্রশ্ন করেন, পঞ্চায়েতে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের সংখ্যা কত? সমরাদিত্যবাবু বলেন, ৫৭ হাজার। বিচারপতির প্রশ্ন: কমিশনের কর্মী কত? সমরাদিত্যবাবুর জবাব: ৩৬ জন কর্মী, ১ জন অফিসার। বিচারপতি জানতে চান, এত কম কর্মী নিয়ে দুর্গম এলাকায় কী ভাবে কমিশন কাজ করে? “অন্য রাজ্য থেকে কি কর্মী আনা যায় না?” প্রশ্ন বিচারপতির। সমরাদিত্যবাবুর বক্তব্য: কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে। ব্যবস্থাপত্র থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সবটাই রাজ্যের সহায়তায় হয়। এটাই নিয়ম।
অন্য দিকে রাজ্যের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল বলেন, সরকার দ্রুত ও অবাধে পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে চায়। এ দিন বিজেপি ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির তরফে আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য ও কৌশিক চন্দ তাঁদের বক্তব্য শুনতে আদালতকে আর্জি জানিয়েছিলেন। বিচারপতি জানিয়ে দেন, মূল মামলা চলছে। এখন দলের বক্তব্য শোনার প্রয়োজন নেই। কমিশন ও রাজ্যের সওয়াল শেষ হওয়ার পরে যদি প্রয়োজন থাকে, তখন শোনা হবে।
মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী কাল, বৃহস্পতিবার। বিকেল তিনটেয়।
|