প্রস্তাবের চেয়েও যোজনায় লাফ ৪০০ কোটি
বৈঠকে ঢুকেছিলেন রেগে আগুন হয়ে। বেরোলেন মুখে সন্তুষ্টির হাসি নিয়ে।
বাইরে এসএফআইয়ের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মধ্যেই যোজনা কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ৩০ হাজার ৩১৪ কোটি টাকার যোজনা আয়তন মঞ্জুর করিয়ে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত বছরের তুলনায় যা ১৭ শতাংশ বেশি। রাজ্যের মূল প্রস্তাবের চেয়েও প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বেশি। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কেন্দ্রীয় সহায়তার পরিমাণও। যাতে তিনি সন্তুষ্ট বলেই জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
এতে যে রাজ্যের ঋণ সমস্যার মিটবে, তা নয়। মমতা আজ যোজনা কমিশনকেও বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, তাঁর সরকার রাজস্ব আয় ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩২ হাজার কোটি টাকা করেছে। কিন্তু সুদ মেটাতেই ২৫ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে যোজনা কমিশনের বিশেষ কিছু করার ছিল না। তবে তাঁর দফতরের দোরে এসে বিক্ষোভ-হাঙ্গামায় ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ অতিথিকে আর অসন্তুষ্ট করতে চাননি মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া। বৈঠকের শেষে দেখা যায়, রাজ্যের প্রস্তাবের চেয়েও যোজনা বেড়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। সাগর ও রসুলপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর বা নয়াচরে ইকো-ট্যুরিজম আটকে থাকা রাজ্যের প্রকল্পগুলি যাতে দ্রুত ছাড়পত্র পায়, সে ক্ষেত্রেও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মন্টেক। আরও এক ধাপ এগিয়ে যোজনা কমিশনের তরফে বলা হয়েছে, শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের একটি ভাবমূর্তি রয়েছে। তাই রাজ্যে শিল্প-বাণিজ্যের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এবং শিল্পগুচ্ছ তৈরিতে সাহায্য করতে চায় কমিশন।
বৈঠক শেষে। মঙ্গলবার দিল্লিতে মন্টেক ও মমতা। ছবি: পিটিআই
রাজ্য সরকারের কাজের প্রশংসা করে মন্টেক বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক বৃদ্ধির হার জাতীয় গড়ের থেকেও ভাল। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ খরচের ক্ষেত্রেও রাজ্য ভাল কাজ করেছে।” পশ্চিমবঙ্গ গত বছর রাজস্ব আয় বাড়িয়েছে। কমিশনের উপাধ্যক্ষ মনে করেন, এই ধারা বজায় রাখা জরুরি। স্বাস্থ্য, সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রকল্প, হর্টিকালচারের মতো ক্ষেত্রে রাজ্য ভাল কাজ করছে। পর্যটন ক্ষেত্রেও রাজ্যে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বস্ত্র শিল্পে রফতানির সুযোগ থাকায় এ ক্ষেত্রেও উৎসাহ দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন মন্টেক।
গত বছর যোজনা কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে যোজনা আয়তন ১৬.৫ শতাংশ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু তখন তাঁরা ইউপিএ-র প্রধান শরিক। ইউপিএ ছাড়ার পরে এখন পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এখন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগে সুর চড়িয়েছে তৃণমূল। ফলে কেন্দ্রের দিক থেকেও তাই দায় ছিল মমতা যাতে যোজনা বরাদ্দ নিয়ে অন্তত বঞ্চনার অভিযোগ তুলতে না পারেন। রাজ্যের প্রাথমিক ভাবে ২৯ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার যোজনা আয়তনের দাবি জানানো হয়েছিল। বৈঠকে আলোচনার পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে এককালীন বিশেষ কেন্দ্রীয় সহায়তার পরিমাণ ১১৪ কোটি টাকা। বাকি অর্থ আসবে রাজ্যের আয় ও কেন্দ্রীয় অনুদান থেকে। কেন্দ্রীয় সাহায্যের পরিমাণ গতবারের ৭ হাজার ২৯৮ কোটি টাকার থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৮০০ কোটি টাক। পাশাপাশি পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিশেষ প্রকল্পের জন্য যে অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় সহায়তা দেওয়া হয়, তা-ও ৬ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। গত বার যা ছিল ৬ হাজার ১৫২ কোটি টাকা।
এ বারের দিল্লি সফরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দরবার এবং সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তাঁর সরকারের ও নিজের প্রশাসনিক ভাবমূর্তি ফেরানো। কিন্তু যোজনা কমিশনে ঢুকতে গিয়ে বিক্ষোভে সেই সুর কাটে। নিজের ও অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের হেনস্থার পরে মেজাজ হারিয়ে মন্টেক এবং যোজনা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী রাজীব শুক্লর সামনে ক্ষোভ উগরে দেন মমতা। নিরাপত্তার অব্যবস্থার জন্য তাঁদেরই দায়ী করেন তিনি।
এই সবের জেরে বৈঠকটাই না ভেস্তে যায়, তৈরি হয়েছিল এমন আশঙ্কাও। কিন্তু তার পরে নিজেই মাথা ঠান্ডা করে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকী কমিশনের সদস্যদের সামনে রাজ্যের পরিকল্পনা প্রস্তাব বিষয়ক ‘স্লাইড-শো’-টিও নিজেই উপস্থাপন করেন মমতা।
যোজনা কমিশনের কর্তাদের বক্তব্য, রাজ্যের ঋণ সমস্যার কথা তুলে ধরলেও মমতা এ দিন আগের বারের মতো আক্রমণাত্মক মনোভাব নেননি। এ বিষয়ে যোজনা কমিশন বা কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষারোপ করারও চেষ্টা করেননি। রাজ্যের জন্য বাড়তি যোজনা আয়তন মঞ্জুর করার জন্য আজ এক অদ্ভুত কৌশল নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। উৎপাদন, শিল্প, কৃষি, পরিষেবা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই তিনি রাজ্যের সঙ্গে জাতীয় স্তরের বৃদ্ধির হারের তুলনা করে দেখান। দাবি করেন, রাজ্য সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের তুলনায় ভাল কাজ করে দেখিয়েছে। নতুন কর ব্যবস্থায় রাজস্ব আয় বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এমনকী রাজ্যে নতুন শিল্প হচ্ছে না বলে তাঁর সরকারের নীতির সমালোচনা হলেও মমতা দাবি করেছেন, রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার জাতীয় স্তরের দ্বিগুণ। ২০১২-’১৩-য় জাতীয় স্তরে শিল্প ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল ৩.১২ শতাংশ। আর পশ্চিমবঙ্গে এই হার ৬.২৪ শতাংশ। মমতার এই দাবি ঠিক বলে মেনে নিয়েছেন মন্টেক সিংহও। মমতা জানিয়েছেন, ২০১১ সালের মে মাসে তাঁর সরকার ক্ষমতায় আসার পরে এ পর্যন্ত ১.১২ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে রাজ্যে। যেখানে ৩ লক্ষ ১৪ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।
কমিশনের সদস্যদের সামনে মমতা যুক্তি দেন, রাজ্যে কন্যা সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার জন্য তাঁর সরকার বিশেষ নজর দিচ্ছে। জঙ্গলমহল, সুন্দরবন, উত্তরবঙ্গ এবং অন্যান্য অনগ্রসর জেলার উন্নয়নে রাজ্য সরকার বিশেষ প্রকল্প নিচ্ছে। ১১টি পিছিয়ে পড়া জেলায় ৩৫টি সুপার-স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। বৈঠকের পরে মমতা বলেন, “আর্থিক ক্ষেত্রে আমরা দেশের মধ্যে এক নম্বর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আদিবাসী উন্নয়নেও আমরা ভাল কাজ করেছি। জঙ্গলমহল থেকে পাহাড়ে শান্তি বিরাজ করছে।”
বৈঠকের শুরুতে মমতার রুদ্রমূর্তি দেখেছিলেন মন্টেক, রাজীব শুক্লরা। বৈঠক শেষে সেই মমতাই ছিলেন অন্য মেজাজে। মন্টেককে সপারিষদ কলকাতায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান মুখ্যমন্ত্রী। মন্টেকও জানান, যত শীঘ্র সম্ভব তিনি কলকাতায় যাবেন। বিদায় নেওয়ার আগেও সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে মমতা মন্টেককে বলেন, “সুন্দরবনে চলুন। দেখবেন, পর্যটনের কত সুযোগ রয়েছে।” হাসি মুখে সম্মতি জানিয়ে অতিথিকে বিদায় জানান কমিশনের উপাধ্যক্ষ।
মমতার লক্ষ্য এ বার ঋণশোধ নিয়ে রাজ্যের সমস্যা মেটানো। বণিকসভা অ্যাসোচেম ওই সমস্যা কাটাতে পশ্চিমবঙ্গকে ২০ হাজার কোটি টাকা শর্তসাপেক্ষ ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছে যোজনা কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মমতা এই বিষয়ে কী রণনীতি নেন, দেখার অপেক্ষায় রাজ্য।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.