‘ভিক্ষা চাইতে যাচ্ছি না’
প্রাপ্য আদায়ে দিল্লি দরবারে মুখ্যমন্ত্রী
ক দিকে রাজ্যের আর্থিক অবস্থার হাল ফেরাতে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষের কাছে দরবার। অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিজের তো বটেই, রাজ্যের ভাবমূর্তিও ফেরাতে রাজধানীতে সাংবাদিক বৈঠক। এই দুই পরিকল্পনা নিয়েই আজ দিল্লি পৌঁছলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের যোজনা আয়তন নিয়ে যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে তাঁর সপারিষদ বৈঠক। প্রাথমিক ভাবে গত বারের তুলনায় ১৫ শতাংশেরও বেশি যোজনা আয়তন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে রাজ্য। মন্টেকের সঙ্গে কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী তার থেকে বেশি মঞ্জুর করাবেন বলে ধারণা রাজ্যের আমলাদের। এর পরে রাজ্যের আর্থিক উন্নয়ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। বুধবার পি চিদম্বরমের সঙ্গে বসার কথা মমতার।
লোকসভা নির্বাচনের আগে যখন কংগ্রেস ও বিজেপি, দু’দলই নতুন শরিকের সন্ধানে নেমেছে, তখন দিল্লিতে তৃণমূলনেত্রীর পা রাখা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হলেও মমতার দাবি, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “তবে দিল্লিতে আমার অনেক পরিচিত রয়েছেন।” সিপিএমের অবশ্য দাবি, মমতার এ বারের দিল্লি সফরের মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর কথায়, “উনি না বলতে চাইলেও আসলে কংগ্রেসের সঙ্গে দর কষাকষি করতে যাচ্ছেন। সামনে লোকসভা ভোট। যদি ভোট এগিয়ে আসে, তা হলে কোন ভিত্তিতে কংগ্রেস-তৃণমূলের ভাঙা সংসার আবার জোড়া লাগতে পারে, সেটাই দেখতে যাচ্ছেন!”
আমি যাচ্ছি চেয়ারটার কাছে।
ভাল কাজের ভিত্তিতে আমাদের
প্রাপ্য আদায় করতে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
নানা মহলে জল্পনার মধ্যেই এ দিন দিল্লি যাত্রার আগে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি যাচ্ছি চেয়ারটার কাছে। ভাল কাজের ভিত্তিতে আমাদের প্রাপ্য আদায় করতে যাচ্ছি।” মমতা বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংবিধান মেনে সুবিচার আদায়ের জন্য কথা বলব। অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইব, আর কত দিন এ ভাবে চলবে? দু’বছর তো হয়ে গেল।” মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “আমি ভিক্ষা চাইতে যাচ্ছি না। রাজ্য ভাল কাজ করেছে, সেটা জানিয়ে তার বিনিময়ে টাকা আদায় করতে যাচ্ছি। আমি মনে করি, কাজের দিক থেকে এ রাজ্য দেশের মধ্যে এক নম্বরে।” তাঁর সরকার কোনও ভাবেই তিন বছরের বিশেষ প্যাকেজ চায়নি বলেও এ দিন দাবি করেন মমতা।
রাজ্য যথেষ্ট পরিমাণে নিজের রাজস্ব আয় বাড়িয়েছে, মূলত এই যুক্তি দেখিয়েই মন্টেকের কাছে যোজনা আয়তন ও কেন্দ্রীয় সহায়তা বাড়ানোর দাবি জানাবেন মমতা। এ বার ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরের জন্য ২৯,৮৫০ কোটি টাকার যোজনা আয়তন মঞ্জুরের দাবি তুলেছে রাজ্য। গত বছরের তুলনায় যা ১৫.২ শতাংশ বেশি। কেন্দ্রীয় সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোরও দাবি জানিয়েছে রাজ্য। আজও এ নিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে যোজনা কমিশনের কর্তাদের বৈঠক হয়েছে। রাজ্য সরকার সূত্রের বক্তব্য, প্রাথমিক ভাবে ১৫.২ শতাংশ বৃদ্ধির দাবি জানানো হলেও মুখ্যমন্ত্রী-মন্টেক বৈঠকের পর তা ২০ শতাংশের বেশি হতে পারে। কেন্দ্রীয় সহায়তাও যথেষ্ট বাড়তে পারে।
যোজনা কমিশন থেকে শুরু করে অর্থ মন্ত্রক বরাবরই বলে এসেছে, রাজ্যকে নিজের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। কমাতে হবে ঘাটতির পরিমাণ। অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে রাজ্যের তরফে এ বার তাই যোজনা কমিশনের কাছে বলা হচ্ছে, রাজ্য নিজের রাজস্ব আয় বাড়িয়ে ৩২ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে গিয়েছে। রাজস্ব ঘাটতিও কমিয়ে আনা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই রাজ্যের মোট উৎপাদনের তুলনায় রাজস্ব আয়ের হার ছিল ৪ শতাংশের কাছাকাছি। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবর্ষে তা ৫ শতাংশ ছুঁয়েছে বলে দাবি রাজ্যের। এর সঙ্গে তাল রেখে যোজনা আয়তনও বাড়া উচিত বলে অভিমত রাজ্যের। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, “আমরা ভাল কাজ করেছি, তার ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরি হবে। প্রকৃত তথ্য না জেনে অনেকেই রটাচ্ছেন যে যোজনা কমিশন রাজ্যের বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। আজ যে জামার দাম পাঁচ টাকা, কাল সেটা পাঁচ টাকা পাঁচ পয়সা হবে না?” কেন্দ্রের উপর চাপ বাড়াতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়েছেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
গত বছর মমতার দাবি মেনে ১৪১ কোটি টাকার এককালীন অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় সহায়তার ব্যবস্থা করেছিলেন মন্টেক। এ বছর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নিজেই পরিকল্পনা খাতে খরচ কমিয়েছেন। ফলে রাজ্যগুলির জন্য বাজেট সহায়তার পরিমাণও কমবে। এককালীন অতিরিক্ত সহায়তা ছাড়াও গত বছর নিয়মমাফিক ৭,২৯৮ কোটি টাকার কেন্দ্রীয় সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এ বার এই সহায়তার পরিমাণ বেড়ে ৯ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে বলে রাজ্যের আশা। সরকারের দাবি, মোট যোজনা আয়তনের বেশির ভাগই ব্যয় হবে সামাজিক ক্ষেত্রে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ উন্নয়ন, সেচ সব ক’টি ক্ষেত্রেই গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
একের পর এক ঘটনায় জাতীয় স্তরে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে তো বটেই মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এর ফলে রাজ্যে নতুন বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে বলেও মনে করছেন তাঁরা। সে কারণেই এ বারের দিল্লি সফরে জাতীয় সংবাদমাধ্যমের সামনে রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে চান মমতা। দিল্লি আসার আগে আজ ফের কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, কেরল, পঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গ ঋণের ভারে জর্জরিত। কিন্তু ওই দুই রাজ্য নানা ভাবে টাকা পেয়েছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গ বঞ্চিত। তিনি বলেন, “কংগ্রেসের নিজস্ব সরকার থাকলে ওরা নানা ভাবে ব্যবস্থা করে দেয়। আর আমরা ভাল কাজ করেও কিছু পাচ্ছি না। এর আগে বহু বার প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি। আবারও বলতে যাচ্ছি। এ বারও না শুনলে ঠিক করব, পরে কী করা যায়।” জঙ্গলমহলে চালের বরাদ্দও কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে বলে অভিযোগ তাঁর। যে অভিযোগকে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে দাবি করেন, গ্রামীণ সড়কে গত এক বছরে রাজ্য কেন্দ্রের থেকে যে টাকা দিয়েছে, তা আগের দশ বছরেও পায়নি। জয়রাম বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, এ সব অভিযোগ তোলার আগে উনি যেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একবার কথা বলে নেন।” কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অসত্য কথা বলেছেন তার তীব্র প্রতিবাদ করছি।” রাজ্যের আর্থিক দুরবস্থার জন্য আজ ফের বাম জমানাকেই দুষেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “ফিসকাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট (এফআরবিএম) কেন সিপিএমের আমলে কার্যকরী হয়নি? কেন আগের সরকারকে বাইরে থেকে দেনা করারও অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল?” তাঁর যুক্তি, “রাজ্য থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা কর পাওয়া যায়। আমরা পাই তা থেকে বড় জোর ১৮ হাজার কোটি টাকা। আগের বন্ধু সরকার এত দেনা করেছে যে সুদ দিতে ২১ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। এ বছর ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় করেছি। আরও ৪ হাজার কোটি টাকা কেটেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সব মিলিয়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা সুদ দিতেই খরচ হয়ে যাচ্ছে।”
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য উড়িয়ে সূর্যকান্তের পাল্টা অভিযোগ, বাজার থেকে ঋণ করে বর্তমান সরকারই পশ্চিমবঙ্গকে এক নম্বরে নিয়ে গিয়েছে! তিনি আরও বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের ন্যায্য দাবির কথা বললে এখনও আমরা সমর্থন করব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.