আপাত ভাবে নিরীহ একটা চিঠি। কিন্তু তাতেই ফের পারদ চড়ল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিটা লিখেছেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। যার বয়ান, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে পাকা রাস্তা তৈরি করার জন্য অর্থ বরাদ্দে কার্পণ্য করছে না কেন্দ্র। কিন্তু যে টাকা দেওয়া হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খরচ হবে তো? যদি খরচ বাড়ে, তার দায় রাজ্য বহন করতে পারবে তো? মুখ্যমন্ত্রীকে ‘মাই ডিয়ার মমতা দিদি’ সম্বোধন করে এমনই পত্রাঘাত করেছেন জয়রাম। চিঠিতে তাঁর বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনায় ১৩৯০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দের আগে রাজ্য সরকারকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
জয়রামের লেখা ৪ এপ্রিলের চিঠিটি সোমবার হাতে পেয়েছে রাজ্যের পঞ্চায়েত দফতর। চিঠি পেয়ে বিলক্ষণ চটেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, চিঠির উপযুক্ত জবাব দেওয়া হোক। পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
তৃণমূলের নিচুতলার নেতা-কর্মীদের তোলাবাজির দাপটে ঠিকাদারেরা কাজ করতে আসছেন না বলে একাধিক বারই অভিযোগ উঠেছে। তা সে কোতোয়ালি-ইংরেজবাজার সড়ক হোক বা কেলেঘাই-কপালেশ্বরী প্রকল্প বা নয়াগ্রামে সেতু বহু ক্ষেত্রেই তোলাবাজদের দাপট টের পেয়েছেন ঠিকাদারেরা। বহু সরকারি প্রকল্পেই বার বার টেন্ডার ডাকা হলেও কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, এমন ঘটনাও অসংখ্য। সেই কারণেই রেকর্ড বরাদ্দ হলেও কাজ তোলার ক্ষেত্রে এ রাজ্যের সাম্প্রতিক সাফল্য তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। পঞ্চায়েত দফতরের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, জয়রাম খোঁজখবর রাখেন। তাই নতুন বরাদ্দের আগে এমন খোঁচা দিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য তাঁর দলের নিচুতলার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ওঠা তোলাবাজির অভিযোগ মানতেই নারাজ। বরং জয়রামের চিঠির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় যথেষ্ট কাজ না হওয়ার দায় সিপিএমের ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, বিভিন্ন ঠিকাদার সংস্থার সঙ্গে সিপিএমের অশুভ যোগসাজস রয়েছে। তাই বহু ঠিকাদার গ্রামের রাস্তা তৈরির ব্যাপারে দরপত্র দিয়েও কাজ করেনি কিংবা কাজ নিয়ে টালবাহানা করেছে। এই সংস্থাগুলিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
সোমবার মহাকরণে এক সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ঠিকাদারদের একটা অংশ দুর্নীতি আর সিপিএমের সঙ্গে মিলেছে। অনেক চক্রান্ত হয়েছে। ইচ্ছা করে বহু সংস্থাকে টেন্ডারে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। ছোট কাজ হলে করব না, বড় বলে করব এটা কোনও কথা হতে পারে না। টেন্ডার পেয়েও এক বছর ফেলে রাখলাম, এটা অপরাধ। সরকার এই সংস্থাগুলিকে কালো তালিকাভুক্ত করবে।” মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, প্রয়োজন হলে নতুন নতুন ছেলেদের ঠিকাদারিতে লাগানো হবে। তাঁর কথায়, “তারা তো চুরি করবে না, কাজ করে পয়সা পাবে।”
মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ উড়িয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এই পরিস্থিতির জন্য মমতা তথা তৃণমূলকেই দায়ী করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ প্রসঙ্গে এ দিন তিনি বলেন, “নৈরাজ্য, তোলাবাজি এ সবে ওঁরাই রেকর্ড করেছেন।”
বিরোধী দলনেতার বক্তব্যের সমর্থন মিলেছে ঠিকাদার সংস্থাগুলির তরফেও। প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনার ঠিকাদার সংগঠনের কর্তা ক্ষেমেন্দ্রকুমার মজুমদার বলেন, “কী ভাবে কাজ করব? কাজ করতে নামলেই দলে দলে এসে চাঁদা চাইছে। কারা চাইছে, সে সব বলতে পারব না। শুধু চাঁদা নয়, কেউ এসে আবার বলছে, পুকুর পাড় বাঁধিয়ে দিতে হবে, গোয়াল ঘরে ইট পাততে হবে। সেই সঙ্গে জমির সমস্যা রয়েছে। তাই ঠিকাদারেরা ওই প্রকল্পে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।”
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিনই জয়রামকে পাল্টা চিঠি দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, রাজ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সমস্ত রাস্তার কাজ শেষ করবে। জঙ্গলমহলে রাস্তার কাজ যাতে দ্রুত শেষ হয়, সে জন্য অতিরিক্ত ৬টি ‘প্রকল্প রূপায়ণ শাখা’ (পিআইইউ) তৈরি করা হবে। চিঠিতে সুব্রতবাবুর বক্তব্য, যা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, তাতে অযথা উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। পঞ্চায়েত দফতর রাস্তা নির্মাণের কাজ শেষ করতে বদ্ধপরিকর।
দিল্লি থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো চিঠিতে জয়রামের বক্তব্য, ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে ৬২৮টি রাস্তার জন্য ১৩৯০ কোটি টাকা রাজ্যকে দেবে কেন্দ্র। এই টাকায় ২৬৫১ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হবে। কিন্তু তার আগে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এর পরেই রমেশ বলেছেন, ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে জঙ্গলমহলে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জন্য ১৪৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই তিনটি জেলার জন্য এ বার আরও ৮৬৬.৫ কোটি টাকা দেওয়া হবে। যাতে জঙ্গলমহলের ১৬২৪ কিলোমিটার রাস্তা পাকা হবে। ৫১৯টি গ্রাম পাকা রাস্তা দিয়ে যুক্ত হবে। দেশের কোনও রাজ্যের জন্য এমন বরাদ্দ করা হয়নি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিপুল বরাদ্দ পেলেই হবে না। সময়ে কাজ শেষ করার দায়িত্ব আপনাদেরই নিতে হবে। সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে মূল্যবৃদ্ধির জেরে প্রকল্পের খরচও বেড়ে যাবে। সেই দায় রাজ্যকেই নিতে হবে। এই চাপের কথা স্মরণ করিয়ে জয়রামের বক্তব্য, সময়ে টাকা খরচ করতে পারবে তো রাজ্য?
পঞ্চায়েত কর্তাদের দাবি, প্রকল্প রূপায়ণ শাখার সংখ্যা রাজ্যে পর্যাপ্ত ছিল না। জঙ্গলমহলে মাত্র ৬টি এমন শাখা সমস্ত প্রকল্প রূপায়ণের দেখভাল করত। এ বার আরও ৬টি প্রকল্প রূপায়ণ শাখা তৈরি করা হবে। কর্তাদের আরও বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনার প্রকল্পভিত্তিক গাইডলাইনে কোথাও প্রকল্পের খরচ বাড়লে তা রাজ্যের ঘাড়ে চাপবে, এমন কথা বলা নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তা-ও এ কথা লিখেছেন। রাজ্যের পক্ষে এই দায় নেওয়া কঠিন।
গত দু’বছরে জয়রামের মন্ত্রক এ রাজ্যের জন্য প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা মঞ্জুর করেছে। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা শুরু হওয়ার পর থেকে এক সঙ্গে এত রাস্তা নির্মাণের অনুমোদন আগে কখনও মেলেনি। ২০১২-১৩ সালেই অতিরিক্ত ৬১৪৩ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্র। সেই বাবদ ৩৪৯০ কোটি টাকাও এসেছে। সেই টাকায় ১৪২৫টি রাস্তার কাজ দিতে দরপত্র চাওয়া হয়েছিল। দু’বার টেন্ডার ডাকার পরও মাত্র ৭৫০টি রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। বাকি রাস্তার কাজ এক বছর পরেও শুরুই করতে পারেনি রাজ্য। জয়রামের কাছে এই খবর পৌঁছেছে। সেই কারণেই নতুন রাস্তার অনুমোদন দেওয়ার আগে খরচ করার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
পঞ্চায়েত দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, কারও খাওয়ার ক্ষমতার চেয়ে বেশি খাবার বরাদ্দ হলে যা হওয়ার, তাই হয়েছে। উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে খাবার। পঞ্চায়েত দফতর যে পরিমাণ কাজ করতে পারে, তার চেয়ে বেশি রাস্তা নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ফলে বহু রাস্তার কাজ শুরুই হয়নি! সেই কারণেই সময়ে কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি চেয়েছেন জয়রাম।
|