শীতে এক দিনের জন্য হলেও লন্ডনকে টেক্কা দিয়েছিল কলকাতা!
আর মরসুম শুরু হতে না-হতেই গরমের কলকাতা ছাপিয়ে গেল দিল্লিকে। পটনা-রাঁচিকেও।
দহনের প্রকৃতিটাও এ বার বিচিত্র। ঘাম নেই। আবহাওয়া শুকনো খটখটে। ভরদুপুরে যেন হলকা লাগছে গায়ে। আবার রাত নামলেই তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে অনেকটা। মহানগরে চৈত্রের চেনা ছবির সঙ্গে এর যেন কোনও মিলই নেই। কেন?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আবহাওয়ার খামখেয়ালেই উত্তর ভারত, বিহার, ঝাড়খণ্ডের গরম হাজির হয়েছে মহানগরে। রোদের তেজে দিল্লি, পটনা, রাঁচিকে টেক্কা দিচ্ছে কলকাতা। কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকায় সোমবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে চার ডিগ্রি বেশি। দিল্লি সেখানে ৩৭.৫, কলকাতার থেকে দু’ডিগ্রি কম। আর পটনা ৩৯.৪। রাঁচি ৩৬.৮।
গরমে শুকনো হাওয়া আর চড়া রোদ দিল্লি, হরিয়ানার মতো শহরের স্বাভাবিক ছবি। সেখানে ‘লু’ বা গরম হাওয়ার দেখাও মেলে আকছার। কিন্তু কলকাতার ছবিটা তো এমন হওয়ার নয়। আবহবিজ্ঞানীরা বলছেন, কলকাতা সমুদ্রের কাছে বলে গ্রীষ্মে এখানকার বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ বছর সেই স্বাভাবিক আবহাওয়া মিলছে না। দিনে বইছে শুকনো গরম হাওয়া, রাতের তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের কাছাকাছি থাকছে। এ দিন কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৫.৯ ডিগ্রি। স্বাভাবিকের থেকে মাত্র এক ডিগ্রি বেশি। |
পারদ-পরাক্রম |
শহর |
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা* |
কলকাতা |
৩৯.৬ (+৪) |
পটনা |
৩৯.৪ (+২) |
দিল্লি |
৩৭.৫ (+৩) |
রাঁচি |
৩৬.৮ (+২) |
জেলা |
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা* |
বাঁকুড়া |
৪২ (+৫) |
বর্ধমান |
৩৯.৪ (+২) |
শ্রীনিকেতন |
৪১.২ (+৪) |
*ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সোমবার |
|
যদিও অন্যান্য বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, এই সময় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে আরও কিছুটা বেশিই থাকাই দস্তুর। শেষ চৈত্রেই এই পরিস্থিতি কেন?
আবহবিজ্ঞানীরা বলছেন, বঙ্গোপসাগর থেকে এখনও যথেষ্ট পরিমাণে জলীয় বাষ্প দক্ষিণবঙ্গের পরিমণ্ডলে ঢুকছে না। তাই বাতাসের আর্দ্রতাও তুলনায় কম থাকছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ জানান, বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে পশ্চিমী হাওয়ার দাপট রয়েছে। তার ফলে জলীয় বাষ্প থাকছে নীচের স্তরেই। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারত ও সংলগ্ন বাংলাদেশের একটি ঘূর্ণাবর্ত। এক আবহবিদ জানান, ঘূর্ণাবর্তটি বায়ুমণ্ডলের নীচের স্তরে থাকা জলীয় বাষ্প টেনে নিচ্ছে। ফলে আবহাওয়া শুকনো আবহাওয়া হয়ে পড়ছে। অন্যান্য বার মার্চেই দু’-একটি কালবৈশাখী হয়ে যায়। এ বছর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরেও কালবৈশাখীর দেখা নেই। আবহবিদেরা বলছেন, কম জলীয় বাষ্প ও বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে পশ্চিমী হাওয়ার দখলদারি এই দুইয়ের প্রভাবে মেঘ তৈরি হচ্ছে না। তাই দেখা মিলছে না ঝড়বৃষ্টিরও।
আবহবিদেরা জানান, বায়ুমণ্ডলের নীচের স্তরে থাকা জলীয় বাষ্পের প্রভাবেই সকালে কোথাও কোথাও হাল্কা মেঘ বা কুয়াশা হয়েছে। কিন্তু বেলা বাড়তেই ফের বেড়েছে রোদের তেজ। দুপুরের চোখ ঝলসে যাওয়া রোদের সঙ্গে বয়েছে গরম বাতাস। পথেঘাটে রোদচশমার মিছিল। রুমাল-ওড়নায় নাকমুখ ঢাকছেন অনেকে। |
হাওয়া অফিসের খবর, বাঁকুড়ায় এ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রি। স্বাভাবিকের তুলনায় পাঁচ ডিগ্রি বেশি। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে পাঁচ ডিগ্রি বেশি হলেই আবহবিজ্ঞান তাকে বলে তাপপ্রবাহ। অর্থাৎ বাঁকুড়ায় তাপপ্রবাহ শুরু। কমবেশি একই অবস্থা ওই এলাকার অন্যান্য জেলাতেও। ওই সব জেলায় আজ, মঙ্গলবারেও এমন পরিস্থিতি চলবে। কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় চলবে শুকনো আবহাওয়া।
আবহবিদেরা অবশ্য পারদের এই ঊর্ধ্বগতিকে অস্বাভাবিক বলতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, গত তিন-চার বছরে কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকায় এপ্রিলের গড় তাপমাত্রা এমনই ছিল। ২০১০ সালের ৯ এপ্রিল মহানগরী ও আশপাশের তাপমাত্রা ছিল ৪০.১ ডিগ্রি। জলীয় বাষ্প কমে যাওয়াটাই তাঁদের বেশি ভাবাচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, এই আবহাওয়ায় সব বয়সের মানুষই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।
এই রাক্ষুসে গরমের মোকাবিলায় কী করবেন মানুষ? বিশিষ্ট চিকিৎসকেরা বলছেন, পথে বেরোতে হলে ছাতা আর রোদচশমা নিতেই হবে। পরতে হবে হাল্কা রঙের জামাকাপড়। বেশি তেল-মশলাদার খাবার চলবে না। রাস্তার কাটা ফল ও জল একেবারেই নয়। চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র বলছেন:
• হিটস্ট্রোক এড়াতে সঙ্গে ছাতা ও জলের বোতল রাখা জরুরি।
• ভরদুপুরে খেলাধুলো নয়।
• রোদ থেকে ফিরে ঠান্ডা জল খাওয়া বা স্নান চলবে না।
এই গরমে শিশুদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা প্রয়োজন বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষ অভিভাবকদের উদ্দেশে বলছেন:
• বাচ্চাদের ভাল করে স্নান করান। দিনে দু’বার হলেও ক্ষতি নেই। তবে গায়ে তেল মাখাবেন না।
• ফোড়া বা ছত্রাকঘটিত সংক্রমণ এড়াতে ত্বক পরিষ্কার রাখুন।
• জল ফুটিয়ে খাওয়ান।
• চড়া রোদে ঘুরতে বা খেলাধুলো করতে দেবেন না।
• বেড়াতে হলে যান শীতের দেশে।
|