বদলের বন্দর
ভারসাম্যের রাজনীতিতে যেন নাগরদোলার ওঠাপড়া
ত প্রায় তিরিশ বছর ধরে খিদিরপুর-গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ এলাকায় ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে উঠে এসেছে আনসারি পরিবারের নাম। মুন্না বা মোক্তারের মতো সরাসরি রাস্তায় নেমে গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ার ইতিহাস নেই এই পরিবারের লোকজনের। পর্দার আড়ালে থেকে তাঁরা ভোগ করেছেন ক্ষমতা। মোগল-মোক্তার-মুন্নার জমানাতেও এই পরিবারের দাপট এতটুকু কমেনি। পুলিশ জানাচ্ছে, এই পরিবার থেকে একই সঙ্গে উঠে এসেছেন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বন্দরের রাজনীতির সেই জন্মলগ্ন থেকেই।
তবরেজ সেই পরিবারেরই সন্তান। বছর পঁয়ত্রিশের যুবক। ফর্সা, মাঝারি উচ্চতা। সুভাষী। হিন্দি ও বাংলার পাশাপাশি চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। মিশনারি স্কুলে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশোনা করে নেমে পড়েন ব্যবসায়। বাবা সামসুজ্জামান আনসারি ও স্ত্রী রুবিনা দু’জনেই তৃণমূল কাউন্সিলর। মুন্না-মোক্তার জমানার শেষ দিকে বন্দরের কানা গলি থেকে উঠে আসতে শুরু করেছে তাঁর নাম। অবৈধ নির্মাণ ও তোলাবাজির সঙ্গে এই প্রথম জড়িয়ে গিয়েছেন আনসারি পরিবারের কেউ। ফোনে অনেক কষ্টে ধরা গিয়েছিল তাঁকে। তবরেজের দাবি, “আমাদের পরিবারের তোলাবাজির টাকার প্রয়োজন নেই। আমাদের গাড়ি ও কাপড়ের ব্যবসা রয়েছে। আমরা গরিব মানুষের উপকার করি। সেই কারণেই রাজনীতি করি।”
পুলিশ অফিসার খুনের মদতে মুন্না যে ভাবে ফেঁসে গিয়েছেন, তাতে তাঁর জামিন পাওয়া এবং বন্দরে ফিরে হৃত জমি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলে মনে করছেন শহরের আইনজীবীরা। অভিজ্ঞ আইনজীবীদের মতে, এ ক্ষেত্রে মোক্তারের অবস্থান অপেক্ষাকৃত ভাল। তবে তা আদালতের উপরে নির্ভর করে।


মহম্মদ ইকবাল


মোক্তার আহমেদ
কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “বন্দর এলাকায় বর বদল হয়। কিন্তু বরযাত্রী একই থাকে।” যার অর্থ, যে মুখগুলোকে গত কয়েক বছর ধরে মুন্নার সঙ্গে ঘুরতে দেখা গিয়েছে, এ বার সুযোগ বুঝে তাঁরা বদলে ফেলবেন শিবির। পুলিশকর্তার ব্যাখ্যা, মোক্তার রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছেন। তিনি সম্প্রতি নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তবরেজের ভাইয়ের সঙ্গে। রাজনীতিকদের মতে, জেল খেটে ফিরে আসার পরে বন্দরে আরও ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যেই মোক্তারের এই চাল।
বন্দরে গুঞ্জন, মোক্তার যদি বন্দিদশা থেকে ফিরে আসেন, তা হলে দু’টি ওয়ার্ডের সীমানা ছাড়িয়ে বন্দর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেবেন তবরেজ। তবরেজ অবশ্য বন্দর জুড়ে এলাকা দখলের খুনখারাপির রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চান না। তাঁর কথায়, “আমাদের হাতে এখন দু’টি ওয়ার্ড রয়েছে। একটি আমার স্ত্রীর। আর একটি আমার বাবার। আমি ওই এলাকাই দেখাশোনা করব।”
পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে অন্য এক ছবি। বন্দরের যে বড় পাঁচটি সংস্থার কর্মী ইউনিয়ন মুন্না নিয়ন্ত্রণ করতেন, সম্প্রতি সেই ইউনিয়নের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তাঁর কন্যা সাবাতাজ। ইনিও কনভেন্টে পড়া শিক্ষিত তরুণী। এখন মাস-কমিউনিকেশনস নিয়ে পড়াশোনা করছেন। বাবার ফেলে যাওয়া জমিতে আস্তে আস্তে পা-ও রাখতে চাইছেন তিনি। মুন্না ফেরার হয়ে যাওয়ার পরে বাড়ি সংলগ্ন ওয়ার্ড অফিসে নিয়ম করে বসছেন সাবাতাজ। জনসংযোগ রেখে চলছেন স্থানীয়দের সঙ্গে। বাবার ব্যবসাও দেখভাল করছেন তিনি।
যে যে দিনগুলিতে মুন্নাকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে, সাবা নিয়ম করে উপস্থিত থাকছেন। মাঝে ভবানী ভবনেও গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। মুন্নার আইনজীবীর সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন তিনি। তা হলে কি সরাসরি রাজনীতির মঞ্চেই নেমে পড়লেন সাবা? তাঁর উত্তর, “এই মুহূর্তে সে সব কিছু ভাবছি না। যদি রাজনীতি করি, তা হলে কোনও দলের সমর্থন না নিয়ে নির্দল হিসেবে করার চেষ্টা করব। তারও আগে আমার এখন দু’টি লক্ষ্য। এক, বাবাকে জেল থেকে বার করে আনা। দুই, গরিব মানুষের পাশে থাকা।”
রাজনীতিবিদদের মতে, বন্দরে ফিরে আসার পরে মোক্তার যত বেশি ক্ষমতা দখল করবেন, তত বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়বে মুন্নার পরিবার। মুন্নার বড় ছেলে অনিল ফেরার। রয়েছেন মুন্নার স্ত্রী, মেয়ে সাবাতাজ ও স্কুলপড়ুয়া আর এক ছেলে। প্রশ্ন উঠেছে, কে নিরাপত্তা দেবে তাঁদের? যাঁরা মুন্নার পাশে এত দিন নিরাপত্তার বলয় তৈরি করে রাখতেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন জেলে, কয়েক জন ফেরার এবং বাকিরা দল ছাড়বেন কি না, তা নিয়ে দোটানায় রয়েছেন। রাজনীতির কারবারিদের বক্তব্য, এই পরিস্থিতি আগে থেকে আঁচ করতে পেরেই মুন্নার মেয়ে সাবাতাজ নেমে পড়েছেন খোলা মঞ্চে।
রাজনীতির সূত্র জানাচ্ছে, বন্দর এলাকায় তৃণমূলের নিচুতলার কর্মীরা এই মুহূর্তে হতাশ। পুলিশ ও প্রশাসন যে ‘মুন্নাভাই’-এর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন তাঁরা। মুন্নার ছায়াসঙ্গী শানু গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের পর থেকে ফেরার। পুলিশ তাঁকে পেলে সটান চালান করে দেবে গারদে। বলা হচ্ছে, মুন্নার অনুপস্থিতিতে একমাত্র শানুই নাকি সামলাতে পারতেন তাঁর সাম্রাজ্য। ফলে পিছু হটছেন তৃণমূলের নিচুতলার কর্মীরা। বলছেন, যাঁর উপরে তাঁদের সব চেয়ে বেশি ভরসা ছিল, যাঁর স্নেহের হাত ছিল মুন্নার মাথার উপরে, সেই ‘দাদা’ই এখন তাঁদের চিনতে পারছেন না। তা হলে কার ভরসায় দাঁড়িয়ে বন্দরে রাজনীতি করবেন তাঁরা? এক সুন্দরী, যুবতী মেয়ে এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে দলের কর্মীদের ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। মনে করা হচ্ছে, এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সাধারণ মানুষের কিছুটা সমর্থন তিনি পাবেন। বস্তির ছোট্ট ঘরে বসে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই বৃদ্ধ বলেন, “সাবাতাজকে বজায় রাখতে হবে তাঁর আজকের দাপট। সেই দাপটই রক্ষা করতে পারবে তাঁর পরিবারকে।” এটাই নাকি বন্দর এলাকার দস্তুর। এটাই তাঁর একমাত্র নিরাপত্তা-বলয়।
(চলবে)


পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.