রোজ শুনানির আর্জি কমিশনের
ঐতিহ্যের গেরোয় ঝুলে নাভিশ্বাস
হাইকোর্টের আপিল মামলাদের
তিহ্যকে বহন করতে গিয়ে আপস করতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীর অধিকারের সঙ্গে! আইনজীবী ও প্রাক্তন বিচারপতিদের অনেকের মতে এমন ঘটনাই ঘটছে কলকাতা হাইকোর্টে।
কী ভাবে? আইনজীবীরা বলছেন, কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা যায় দু’ভাবে। নিম্ন আদালতের বিচারে সন্তুষ্ট না হয়ে কেউ মামলা করলে তা করতে হবে অ্যাপিলেট সাইডে। আবার কলকাতা জেলা (প্রেসিডেন্সি এলাকা)-র অন্তর্গত ১৪টি থানার মানুষ সরাসরি সরকার-বিরোধী বা দেওয়ানি যে কোনও মামলা করতে পারেন কলকাতা হাইকোর্টে। সেই মামলা তাঁদের করতে হবে অরিজিন্যাল সাইডে।
আইনজীবীদের অনেকের মতে, হাইকোর্টে অরিজিন্যাল সাইড থাকার কোনও যৌক্তিকতাই নেই। হাইকোর্ট শুধু আপিল মামলা শুনবে। অর্থাৎ, থাকবে শুধু অ্যাপিলেট সাইড। দেশের অধিকাংশ হাইকোর্টে শুধু অ্যাপিলেট সাইডই রয়েছে বলে জানাচ্ছেন আইনজীবীরা। তাই সেখানে মামলার নিষ্পত্তি হয় দ্রুত।
কলকাতা হাইকোর্ট ছাড়া অরিজিন্যাল সাইড রয়েছে বম্বে এবং মাদ্রাজ হাইকোর্টেও। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টস ইন্ডিয়ান হাইকোর্ট আইনে এই তিন প্রেসিডেন্সি শহরে তিনটি হাইকোর্ট তৈরি হয়েছিল। সেই আইনমাফিক তিন হাইকোর্টেই অ্যাপিলেটের সঙ্গে অরিজিন্যাল সাইডও রাখা হয়। পরে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও এই তিন হাইকোর্টের বিশেষ ক্ষমতাটিকে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
অরিজিন্যাল সাইড থাকার ফলে কী ভাবে বিচারপ্রার্থীর স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে?
কোন বিচারপতি কোন বিষয়ের মামলা শুনবেন, তা ঠিক করে দেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। এক জন বিচারপতির কাছে অরিজিন্যাল এবং অ্যাপিলেট দু’ধরনের মামলাই আসে। কোন মামলা তিনি কী ভাবে শুনবেন, তা ঠিক করেন সংশ্লিষ্ট বিচারপতিই। যেমন, পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন বনাম রাজ্য সরকারের মামলাটি করা হয়েছে অরিজিন্যাল সাইডে। বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার মামলাটি শুনছেন। বিচারপতি সমাদ্দার সপ্তাহে দু’দিন মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার অরিজিন্যাল সাইডের মামলা শোনেন আর বাকি তিন দিন আপিল মামলার বিচার করেন। আর তাতেই পঞ্চায়েত মামলাটি কবে শেষ হবে, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সে জন্য সোমবার কমিশনকে রোজ শুনানির আবেদনও করতে হয়েছে।
কোনও কোনও বিচারপতি আবার একই দিনে কিছু সময় অরিজিন্যাল মামলা কিছু সময় আপিল মামলা শোনেন। এক প্রবীণ আইনজীবীর মন্তব্য, “যে ভাবেই শোনা হোক না কেন, একটি অরিজিন্যাল সাইডের মামলার শুনানি হওয়া মানে একটি আপিল মামলা ঝুলে থাকা। কারণ, অরিজিন্যাল সাইডের মামলার জায়গায় শোনা যেত একটি আপিল মামলা।”
কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, “কেন থাকবে অরিজিন্যাল সাইড? অরিজিন্যাল সাইড না থাকলে আপিল মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। সেটাই কাম্য।” বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এ ব্যাপারে আলোচনা আগেও শোনা গিয়েছে। কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি।” তাঁর মতে, সিটি সিভিল, ব্যাঙ্কশাল ইত্যাদি আদালত যখন আছে, তখন সেখানেই অরিজিন্যাল সাইডের মামলাগুলি যাওয়া উচিত। পরে আপিলের দরকার হলে হাইকোর্টে আসবে। কোনও কোনও আইনজীবীর মতে, সিটি সিভিল বা ব্যাঙ্কশালের মতোই ক্যালকাটা ল কোর্ট থাকলে সেখানেই অরিজিন্যাল সাইডের মামলাগুলি শোনা যেত।
মুম্বই হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় অবশ্য অরিজিনাল সাইড পুরোপুরি তুলে দেওয়া যায় বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, “অরিজিন্যাল সাইড পুরোপুরি তুলে দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ, কপিরাইট, পেটেন্ট, কোম্পানি আইন, জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত মামলার মতো কিছু বিশেষ বিষয় সরাসরি হাইকোর্টে অর্থাৎ অরিজিন্যাল সাইডে দেওয়ার কথা বলা আছে।”
সম্প্রতি হাইকোর্টের অরিজিন্যাল সাইডের ভার লাঘব করতে আইন করেছে রাজ্য সরকার। তাতে বলা হয়েছে, কলকাতার প্রেসিডেন্সি এলাকার ১৪টি থানায় যে সব সম্পত্তির মূল্য এক কোটি টাকার বেশি, সেই মামলাই হাইকোর্টে অরিজিন্যাল সাইডে আনা যাবে। এত দিন সম্পত্তির মূল্য ১০ লক্ষ টাকার বেশি হলেই অরিজিন্যাল সাইডে মামলা করা যেত। এই প্রসঙ্গে বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “এতে অরিজিন্যাল সাইডের ভার লাঘবের চেষ্টা নিশ্চয়ই আছে। তবে তাতে আপিল মামলাগুলির বিচার ত্বরান্বিত হচ্ছে কি না, তা দেখা দরকার।” তিনি বিচারপতিদের সংখ্যার উপরেও জোর দেন। বলেন, “মামলা বাড়লে উপযুক্ত সংখ্যায় বিচারপতিও দরকার। তা আছে কি না, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। নজর দিতে হবে বিচার প্রক্রিয়ার গুণগত মান নিয়েও।”
প্রবীণ আইনজীবী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, হাইকোর্ট থেকে অরিজিন্যাল সাইড তুললে চাপ বাড়বে নিম্ন আদালতগুলিতে। তিনি বলেন, “এর কিছু বিধিনিষেধ আছে। এটাও বুঝতে হবে যে, হাইকোর্টে অরিজিন্যাল সাইড না থাকলে নিম্ন আদালতগুলিতে মামলার সংখ্যা বাড়বে।” তাঁর প্রশ্ন, “তা হলে কি গুচ্ছ গুচ্ছ সিটি সিভিল কোর্টের মতো আদালত তৈরি হবে? তা হলেও কি মামলার নিষ্পত্তি সহজ হবে? গুণগত মানটাও তো দেখতে হবে!” বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের সুরেই সোমনাথবাবু জানান, “বিচারপতি এবং আইনজীবী সকলের গুণগত মান এমন হতে হবে, যাতে মামলার দ্রুত ও সুষ্ঠু নিষ্পত্তি হয়।”
পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে দায়ের করা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ মামলা অরিজিন্যাল সাইড আর অ্যাপিলেট সাইডের দোটানায় পড়ে হাঁসফাঁস করছে। অরিজিন্যাল সাইডে করা মামলাটির শুনানি হচ্ছে সপ্তাহে দু’টি দিন। মামলা কবে শেষ হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নির্বাচন কমিশন। তাই কমিশনের আইনজীবী সমরাদিত্য পালকে সোমবার কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন পেশ করে বলতে হয়েছে, এই মামলাটি যাতে প্রতিদিন শোনা হয়, তার ব্যবস্থা করুক আদালত।
রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়ও রাজ্যের তরফে আবেদন করে বলেন, রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত ভোট করতে ৫ ও ৮ মে দিন ঘোষণা করেছে। সরকারের আবেদন, পঞ্চায়েত আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী কমিশনকে ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশের নির্দেশ দিক হাইকোর্ট। আজ, মঙ্গলবার মামলাটির শুনানি। দু’পক্ষকেই প্রথমে জানাতে হবে, কেন প্রধান আইনজীবীদের একান্ত বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে। তার পরে প্রতিদিন এই মামলা শোনা ও কমিশনের নির্ঘণ্ট প্রকাশের নির্দেশ নিয়েই শুনানির অনেকটা সময় কেটে যাবে। এর জন্য আপিল মামলাগুলিকে অপেক্ষা করতে হবে। তবে একটানা একটি মামলা লাগাতার শোনার অনেক নজির কলকাতা হাইকোর্টে রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রবীণ আইনজীবী এবং প্রাক্তন বিচারপতিদের অনেকে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.