একেই জমির অধিগ্রহণ ও দখল উচ্ছেদ নিয়ে বিস্তর সমস্যা, তার উপরে টাকার টানাটানি। দুইয়ে মিলে কিছুটা জলই ঢেলে দিল রাজ্যের সড়ক সংস্কার উদ্যোগে। আংশিক ভাবে বাতিল হয়ে গেল পুরো দিল্লি রোডের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা। যার জেরে ভবিষ্যতে ওই রাস্তায় যান-দুর্ভোগের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
কথা ছিল, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে পিপিপি) যাবতীয় রাজ্য সড়ক নতুন ভাবে তৈরি করবে ওয়েস্ট বেঙ্গল হাইওয়ে ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন। সেখান থেকে তারা পথ-করও আদায় করবে। প্রথম প্রকল্প হিসেবে কল্যাণী মোড় থেকে ডানকুনি পর্যন্ত দিল্লি রোডের প্রায় ৪২ কিলোমিটার পুরোদস্তুর চার লেন করার পরিকল্পনা নিয়েছিল কর্পোরেশন। হঠাৎই সিদ্ধান্ত বদলে তারা স্থির করেছে, চার লেন হবে শুধু চন্দননগর থেকে ডানকুনি পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার। এবং তার খরচ একা কর্পোরেশনই বহন করবে। বাকি ২৩ কিলোমিটার আপাতত দু’লেনে বাড়ানো হবে।
কেন এই মতবদল?
রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তা বলছেন, আধুনিক মান অনুযায়ী চার লেনের রাস্তা বানাতে যে জমি দরকার, তা কমপক্ষে ২৫ মিটার চওড়া হতে হবে (দু’পাশের সার্ভিস রোডের প্রস্থ ধরে)। দিল্লি রোডের চন্দননগর-ডানকুনি অংশের দু’পাশে ওই বাড়তি জমি পেতে অসুবিধে নেই। কারণ, ওখানে পূর্ত দফতরের নিজস্ব জমি রয়েছে, এবং তাতে জবরদখলও তেমন ভাবে কায়েম হয়নি। ফলে ওই অংশ সম্প্রসারণে বিশেষ সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অন্য দিকে চন্দননগর থেকে কল্যাণী মোড় পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার চার লেন করার মতো জমি পাওয়া মুশকিল। সরকারি সূত্রের খবর: ওই তল্লাটে প্রচুর জায়গায় সরকারি জমি জবরদখল করে বহু বাড়িঘর, দোকানপাট গজিয়ে উঠেছে, রাস্তা চওড়া করতে গেলে যা হঠাতেই হবে। কিন্তু রাজ্যের বর্তমান সরকারের ‘উচ্ছেদ-বিরোধী’ মনোভাবের দরুণ তা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের একাধিক কর্তা। |
তবে জমি যদি হাতে আসতও, তবু পুরো অংশ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হতো কি না, সে সংশয় প্রতিফলিত হয়েছে হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের কর্তাদের কথাতেই। তাঁরা কবুল করছেন, কোষাগারে অর্থের সঙ্কটও সড়ক সম্প্রসারণের পথে মস্ত প্রতিবন্ধক। এক পূর্ত-ইঞ্জিনিয়ার বলেন, “ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি (এনএইচএআই) যে মানের রাস্তা বানায়, তাতে প্রতি কিলোমিটারে ১০-১২ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়। সেই হিসেবে ডানকুনি থেকে কল্যাণী মোড়, মোট ৪২ কিলোমিটার চার লেন করতে প্রায় সাড়ে চারশো-পাঁচশো কোটি লাগার কথা। কর্পোরেশনের হাতে এখন অত টাকা নেই।” কত আছে?
সরকারি সূত্রের খবর: দিল্লি রোড সড়ক সম্প্রসারণ খাতে কর্পোরেশন যে দরপত্র আহ্বান করতে চলেছে, তাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে সাকুল্যে আড়াইশো কোটি টাকা। যা দিয়ে বড়জোর থেকে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার উচ্চমানের রাস্তা তৈরি হতে পারে। বস্তুত সেই হিসেবেই ডানকুনি থেকে চন্দননগর পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আর এই প্রসঙ্গেই প্রশ্ন উঠছে, অর্থের যখন এত সমস্যা, তখন কর্পোরেশন কেন যৌথ উদ্যোগের পথে হাঁটল না?
রাজ্য পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশ জানিয়েছেন, ইদানীং অধিকাংশ রাজ্য রাস্তা নির্মাণ ও তার দেখভালের দায়িত্ব নিজেদের হাতে রাখতে চাইছে না ঠিকই। আর তাই পিপিপি মডেলের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। তবে পিপিপি-প্রকল্পে কাজ শুরু করতে একটু বেশি সময় লাগে। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থাগুলি কাজে নামার আগে নিজেরা এক দফা গোটা প্রকল্পের সমীক্ষা করে। তার পরে সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির পালা। কিন্তু এই মুহূর্তে কর্পোরেশনকে অতটা সময় রাজ্য সরকার দিতে চাইছে না। কেন?
মহাকরণ-সূত্রের ইঙ্গিত, ২০১৬-এর বিধানসভা ভোটের আগে দিল্লি রোডের সংস্কার সেরে ফেলায় জোর দিচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর অফিস। কার্যত তাদের ‘তাগাদাতেই’ পিপিপি’র ভাবনা ছেড়ে নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে রাস্তার কিছু অংশ চার লেনে সম্প্রসারিত করতে নামছে কর্পোরেশন। আড়াইশো কোটি খরচ করে এমন আধাখ্যাঁচড়া কাজে আদৌ কি কোনও লাভ হবে? “একেবারেই নয়।” পরিষ্কার জানাচ্ছেন সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদের একটি মহল। তাঁদের বিশ্লেষণ: দিল্লি রোড দিয়ে এখন রোজ গড়ে ২৫ হাজার গাড়ি চলাচল করে। সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে বলেই কর্পোরেশন রাস্তা চওড়া করার কথা ভেবেছিল। অথচ শুধু ডানকুনি থেকে চন্দননগর অংশ চওড়া হলে কার্যত হিতে বিপরীত হতে পারে। কেননা তখন সম্প্রসারিত অংশে গাড়ির চাপ আরও বাড়বে, তুলনায় সঙ্কীর্ণ অন্য অংশটি (চন্দননগর থেকে কল্যাণী) যা সামাল দিতে পারবে না। ফলে ভবিষ্যতে দিল্লি রোডে যানজটের ছবিটা দস্তুরমতো জটিল হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন ইঞ্জিনিয়ারেরা।
তা হলে পরিকল্পনার নিট ফল কী দাঁড়াচ্ছে?
হাইওয়ে কর্পোরেশনের এমডি মনোজ অগ্রবাল সরাসরি জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন। তাঁর ঘোষণা, “আমরা ওই রাস্তায় টোল আদায় করব। টেন্ডার ডেকে কোনও বেসরকারি সংস্থার হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে। মাসের শেষে টোল বাবদ আয়ের একটা অংশ সরকার নেবে।”
কিন্তু যেখানে জনসাধারণের কাছ থেকে জলকর নিতেও স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি, সেখানে রাজ্য সড়কে পথ-কর আদায়ের অনুমতি তাঁর সরকার দেবে কি না, সেই সংশয়ও দানা বেঁধেছে প্রশাসনের অন্দরে। |