মজাদার হাসি হাসি মুখ। কখনও সিরিয়াস। কখনও রাগ।
বায়ার্ন মিউনিখকে বুন্দেশলিগা চ্যাম্পিয়ন করে এসে ভিড়ে ঠাসা সাংবাদিক সম্মেলনে বলছিলেন নানা কথা। দেখে মনে হচ্ছিল কোনও টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ঠিক যেন অমল দত্ত কথা বলছেন! তবে জ্যাংড়ার কোচের সঙ্গে ইতিহাস গড়ে ফেলা জার্মানির সবথেকে বেশি বয়সের কোচের অমিল একটা জায়গাতেই বিপক্ষ কোচ সম্পর্কে দরাজ হওয়ায়। সামান্যতম কটাক্ষও নেই।
“আরে ৪ ডিগ্রি ঠান্ডায় কোনও দিন কোনও টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হইনি। কিন্তু ছেলেরা যা পরিশ্রম করেছে, বায়ার্ন যে ভাবে এগোচ্ছিল তাতে খেতাবটা ঠান্ডাতেই হয়ে গেল।” জার্মান ভাষায় বলছিলেন বায়ার্ন কোচ জাপ হাইনকেস। এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, কুড়ি পয়েন্টের ব্যবধান রেখে চ্যাম্পিয়ন? পঞ্চাশ বছরের বুন্দেশলিগায় যা বিরলতম ঘটনা। কী বলবেন? তাতেই ঠান্ডার প্রসঙ্গটা টেনে আনেন হাইনকেস। বায়ার্ন কোচ বোঝাতে চাইছিলেন, গত বারের চ্যাম্পিয়ন এবং এ বারের রানার্স বরুসিয়া ডর্টমুন্ড যে কোনও চ্যালেঞ্জ জানাবে না, সেটা ভাবেনইনি।
স্টেডিয়ামের যেখানে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে বায়ার্ন ফ্যানরা ম্যাচের সময় নাগাড়ে ক্লাবের থিম সং গাইছিলেন, ট্রফি নিশ্চিত করার পর সেখানে লাম-মুলার-দাঁন্তেরা কার্যত টেনে নিয়ে যান হাইনকেসকে। ম্যাচের পরই দেখা গিয়েছিল নাচতে নাচতে কখনও সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, কখনও দৌড়ে এসে মাটিতে শুয়ে পড়ছিলেন বায়ার্ন ফুটবলাররা। হাইকেনস যেতেই ফটোগ্রাফারদের অনুরোধে তাঁকে আকাশে তুলে ধরা হয়। ফিরে আসার পর কিন্তু সামান্যতম উচ্ছ্বাসও ছিল না বায়ার্ন কোচের চোখেমুখে। |
গোল করে সোয়াইনস্টাইগারের উচ্ছ্বাস। ফ্রাঙ্কফুর্টে। ছবি: রয়টার্স |
জার্মানির বিভিন্ন কাগজেই গত কয়েক দিন ধরে বেরোচ্ছিল চ্যাম্পিয়ন হলে অন্তত সাতটা রেকর্ড ভাঙবে বায়ার্ন। সঙ্গে ছিল হাইনকেসের গুণগান। বুন্দেশলিগার পর আরও দুটো ট্রফির সামনে দল চ্যম্পিয়ন্স লিগ এবং জার্মান কাপ। তার পরেই সরে যাবেন তিনি। বায়ার্নে নিজের উত্তরসূরি সম্পর্কে হাইকেনস বলছিলেন, “বায়ার্নে পেপের কাজটা অনেক চাপের হয়ে গেল। তবে ও যোগ্য লোক।” নিজের হাতে তৈরি সোনার টিম অন্যের হাতে তুলে দিয়ে যেতে পেরে যেন খুশি হাইনকেস। ভারতের কোচেদের দেখে অভ্যস্ত চোখে যা কিছুটা বিস্ময়করই লাগল। এ রকম সাফল্যের চূড়ায় থেকে অবসর! ভাবাই যায় না।
পেপ গুয়ার্দিওয়ালাকে আনার পিছনে হাইনকেসের অবদান অনেকটাই। সুব্রত ভট্টাচার্য মোহনবাগানে করিম বেঞ্চারিফাকে আনার জন্য কর্তাদের সাহায্য করলে ব্যাপারটা যেমন হবে- সে রকমই।
তবে নিজের কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, বুঝিয়ে দিচ্ছেন হাইনকেস। জার্মানরা তাঁকে আদর করে ডাকেন ‘ওসরম’ বালব্ তৈরির কারখানার নামে এই নামকরণ। কারণ হাইনকেস নাকি যে কোনও অন্ধকার ক্লাবে গেলেই সেখানে আলো আসে! তো গতকাল ‘ওসরম’কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “এর পর কি একেবারেই অবসর?” গাল ঢুকে যাওয়া মুখটা বেশ রেগে ওঠে। “বুধবারই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ। জুভেন্তাসের সঙ্গে। শেষ চারে যেতে হবে। অবসর কোথায়?” পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন হাইনকেস।
বায়ার্ন চেয়ারম্যান রুমেনিগে আবার বলে দিয়েছিলেন, সামনে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। তাই চ্যাম্পিয়ন হলেও ট্রফি নেব না। বুন্দেশলিগার ট্রফি নেননি লাম-মুলাররা। জার্মান চ্যাম্পিয়নরা যে নতুন ট্রফির খোঁজে সেটা মিক্সড জোনে লাম-দাঁন্তেদের কথাবার্তাতেই বোঝা যাচ্ছিল। “ভেবেছিলাম আজ রাতে কয়েকটা নতুন ব্র্যান্ডের বিয়ারের বোতল খুলব। কিন্তু সেটা স্থগিত রাখছি বুধবারের জুভেন্তাস ম্যাচের জন্য।” বলছিলেন অধিনায়ক ফিলিপ লাম। ইংরেজি তর্জমা করছিলেন দোভাষী।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার জন্য এখন বায়ার্ন কতটা মরিয়া সেটা বোঝা গেল এক ধমকেই! দর্শকদের তৈরি করে আনা ট্রফির রেপ্লিকা নিয়ে গানের সঙ্গে নাচতে নাচতে ড্রেসিংরুম থেকে বাইরে আসছিলেন দাঁন্তে। ফটোগ্রাফাররা ছবি তুলতে যেতেই কড়া চোখে তাঁকে ধমকালেন হাইনকেস। একেবারে অমল দত্তর ঢঙে। রিয়াল মাদ্রিদকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানো হাইনকেসের কোচিং জীবনের সেরা সাফল্য। বায়ার্নকেও এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন যে, ইউরোপ সেরা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে গোটা জার্মানি। মে মাসে আটষট্টিতে পা দেওয়া ‘ওসরাম’ যদি সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেন, তা হলে বিশ্বের সবথেকে বাণিজ্যিক ভাবে সফল ক্লাব তাঁকে কোহিনুর করে রাখবে। অন্তত সেটাই বলছেন চেয়ারম্যান কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে। |