ক্রিকেট-ইতিহাসের বাঘা ক্যাপ্টেন নিয়ে বই লিখতে গেলে কোনও দিনই তাঁর নামটা লেখকের মাথায় আসবে না। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো জঙ্গি মনোভাবাপন্ন নন। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির শীতল কাঠিন্য চরিত্রে নেই। স্টিভ ওয়-এর মতো দুঁদেও নন। বরং তাঁকে নিয়ে প্রচলিত প্রবাদ হল, রাহুল শরদ দ্রাবিড় বরাবরই ভাল পার্শ্বনায়ক। নায়ক নন।
আইপিএলে তাঁর বর্তমান ফ্র্যাঞ্চাইজির পূর্বসূরির সঙ্গেও বিন্দুমাত্র মিল আছে কি? রাজস্থান রয়্যালস দেখেছে শেন ওয়ার্নের শাণিত মস্তানি কাকে বলে। বিপক্ষ অধিনায়ককে ‘চিট’ বলে ফেলা, সিগারেট ফুঁকতে-ফুঁকতে প্র্যাক্টিস প্রদর্শন, বান্ধবী লিজ হার্লিকে প্রকাশ্য চুমু কোনও কিছুই তো বাকি রাখেননি ওয়ার্ন। দ্রাবিড়-দর্শনের যা সম্পূর্ণ বিপরীত-ধর্মী। ওয়ার্ন-সুলভ পাগলামি তাঁর কোনও দিন ছিল না। নেই। থাকবেও না।
তবু কোনও এক জাদুমন্ত্রে নিজেদের ‘ক্যাপ্টেন কাম মেন্টর’-এর কথা উঠলে শ্রদ্ধায় মাথা ঝুঁকে যাচ্ছে রাজস্থান রয়্যালসের কর্তাদের। তিনটে ফ্র্যাঞ্চাইজি ঘোরা বাংলার শ্রীবৎস গোস্বামী বলে ফেলতে পারছেন, রয়্যালসেই তিনি সবচেয়ে ভাল আছেন। কেকেআরের চেয়েও! আইপিএল ফাইভ থেকেই রয়্যালস অধিনায়ক দ্রাবিড়। ফ্র্যাঞ্চাইজিকে এমন কিছু দিতে পারেননি। তবে কীসের এই সম্মোহন? |
চল্লিশের চৌকাঠেও সকাল-বিকেল দু’বেলা প্র্যাক্টিসে নেমে টিমে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন, তাই। নিজের বিশাল ভাবমূর্তি ভেঙেচুরে জুনিয়রদের নিয়ে ‘কোর গ্রুপ’ তৈরি করতে পারেন, তাই। আইপিএলের ‘ফ্যালো কড়ি মাখো তেল’-এর দুনিয়াতেও খুঁজে খুঁজে জুনিয়র ক্রিকেটার তুলে আনতে পারেন, তাই। উদাহরণ রাহুল শুক্ল। উদাহরণ সঞ্জু স্যামসন। সচিন বেদি।
টিমে যে টি-টোয়েন্টির মহাতারকা বলতে এক শেন ওয়াটসন ছাড়া কেউ নেই, জানতেন দ্রাবিড়। শুনে নাকি বলেও দিয়েছিলেন, আমার তারকার দরকার নেই। তারকা তৈরি করে নেব। জয়পুরে রয়্যালস সংসারে যার খোঁজ পাওয়া গেল। টিমের সঙ্গে জড়িত একজন বলছিলেন, “মুখে যা বলল, করেও দেখাল। জুনিয়রদের বুঝিয়ে দিল ওরাই সব।” কী রকম? জানা গেল, অজিঙ্ক রাহানে-অশোক মেনেরিয়া-শ্রীবৎস গোস্বামীদের মতো চার-পাঁচ জনকে নিয়ে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করেন দ্রাবিড়। যেটা তাঁর ‘কোর গ্রুপ’। জুনিয়রদের কখনও বলেননি, এটা করে দেখাও। বলেছেন, এটা করো। কী ভাবে করবে, তোমার ব্যাপার। “সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, উনি হারকে মেনে নিতে জানেন। অধিনায়ক হিসেবে বস নন। আমরা কেউ ঘাবড়ে থাকি না। চিলড থাকি। আমাকেই তো যেমন বলেছিলেন, তুমি শুধু আত্মবিশ্বাসটা বাড়াও,” রবিবার প্র্যাকটিস শেষে বলছিলেন শ্রীবৎস। শুধু তাই? রাজস্থান রয়্যালসের প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলার সময় নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে দাঁড়িয়ে একের পর এক নির্দেশ দিয়েছেন নিয়মিত। টিমের মননে গুঁজে দিয়েছেন ‘থ্রি ডি’। অর্থাৎ, ‘ডেডিকেশন, ডিসিপ্লিন, ডিটারমিনেশন’ নামক তাঁর নিজস্ব জয়মন্ত্র। স্থানীয় সাংবাদিকদের বলতে পেরেছেন, “জুনিয়রদের কী ভাবে বুঝতে হয়, সেটা শিখেছি আমার সন্তানদের থেকে।” সঙ্গে চলেছে নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম। নিজেকে ম্যাচ ফিট রাখতে বেঙ্গালুরুতে কেএসসিএ- তে দ্বিতীয় ডিভিশনেও খেলেছেন। সেঞ্চুরি করেছেন। সঙ্গে দু’বেলা প্র্যাকটিস, জিম সেশন।
যে সাধনার হাতেগরম দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল রবিবারের সন্ধেয়। কাফ মাসলে চোট। তাই ক্রিকেট কিট হোটেলে। ম্যাচে নামছেন, কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে অনুশীলন নয়। তবে টিমের প্র্যাকটিসে ঠিক হাজির। মাঝে-মাঝেই ক্রিকেটারদের ডেকে বৈঠক। যেটা তাঁর সংসারের নিয়ম। একটু পর মাঠেই বসে পড়লেন।
চোখ আটকে সামনে। নেটে।
চোখ আটকে দ্রাবিড়-সভ্যতায়। |